বাড়িটি দেখে অনেকেই রিসোর্ট ভেবে ভুল করতে পারেন

আগে থেকে জানাশোনা না থাকলে রিসোর্ট ভেবে যে কেউ ভুল করতে পারেন, কিন্তু আসলে এটি একটি অবকাশ বাড়ি। ‘বনের বাড়ি’ নামের এই বাড়ি এবার ফিলিপাইনে অনুষ্ঠিত আর্ক এশিয়ার ২০তম কংগ্রেসে ‘একক আবাসিক বাড়ি’ বিভাগে সম্মানজনক পুরস্কার জিতেছে। বনের মধ্যে সেই বাড়িতেই একটা দিন কাটিয়ে এলেন হাসান ইমাম

বনের মধ্যে বাড়ি, নামও তাই ‘বনের বাড়ি’

সকালে ঢাকা থেকে যখন রওনা হই, আকাশে তখন অক্টোবরের ঝলমলে রোদ। গাজীপুরের চন্দ্রার একটি গ্রাম আমাদের গন্তব্য। দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা যখন চন্দ্রা হাইওয়েতে, বাইরে তখন হাওয়া বদলাতে শুরু করেছে। ঝকঝকে আকাশ থমথমে চেহারা নিয়েছে। আমরা ঢাকা–টাঙ্গাইল হাইওয়ে ছেড়ে একটা চিকন পথ ধরি।

আঁকাবাঁকা আর ঘন সবুজ বনের মধ্যে দিয়ে আরও প্রায় ছয় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যেখানে থামলাম, তারপর আর রাস্তা নেই। তাতে অবশ্য আমাদের সমস্যা হলো না। কারণ, আমাদের গন্তব্যও এই পর্যন্ত। গাড়ি থেকে নামার আগেই শুরু হলো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। ঝটপট নেমে পড়ে মাথা বাঁচিয়ে দৌড়ে ভেতরে এলাম। দু–তিনটা মাটির ঘর মুখোমুখি করে এক গেরস্তবাড়ির উঠান, সেই উঠান পেরিয়ে গাছগাছালির ভেতর দিয়ে সরু একটি পথ ধরে এগিয়ে গেলেই বনের মধ্যে একটা বাড়ি। এটিই ‘বনের বাড়ি’।

গাছগুলো না কেটে বাড়ির নকশা করা হয়েছে

বাড়িটির সামনে এসে যখন দাঁড়ালাম, চারপাশে গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা যেন অন্য রকম এক গান ধরেছে। দুপুরেই প্রকৃতিতে নেমে এল বিকেলের আবহ। প্রবেশমুখে জুতা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বাড়িতে প্রবেশের মূল পথের পুরোটা জুড়েই কাচের দরজা। মানে বাইরে থেকেও ভেতরটা দেখা যায়। ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেডের স্থপতি ইকবাল হাবিব ও ইশতিয়াক তিতাসের কাছে এই বাড়ি তৈরির প্রস্তাব আসার পর তাঁরা বাড়ির মালিকের সঙ্গে বসেন একাধিকবার। তাঁর সঙ্গে কথা বলেই জানতে পারেন, নিজেদের জমিতে একটা হলিডে হোম বানাতে চান তাঁরা। যেখানে দুই দিনের ছুটিতেও তাঁরা বেড়িয়ে আসতে পারবেন ইচ্ছেমতো। এরপর কয়েক দফা জায়গার ম্যাপ, সরাসরি অবস্থান পরিদর্শন—এসব করে নানা রকম নকশা করতে থাকেন স্থপতিবৃন্দ। যেহেতু বনের মধ্যে বাড়িটি করা হচ্ছে, তাই কোনো কিছু নষ্ট না করে কীভাবে নকশা করা যায়, সেই ভাবনা ছিল সবার মধ্যে।

বনের বাড়ির লিভিংরুম। পর্দা সরালেই আড্ডায় এসে যোগ দেয় প্রকৃতি

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আমরা চাইনি গাছগুলো কাটা পড়ুক। বরং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে কীভাবে বাড়িটির নকশা করা যায়, সেটা ভেবেছি। সেই ভাবনা থেকেই বাড়িটি তৈরির জন্য একাধিকবার অল্পবিস্তর নকশা বদলাতেও হয়েছে। বড় বড় গাছগুলোকে তাদের মতো জায়গা দিয়েই ফাঁক দিয়ে বাড়িটি গড়ে তোলা হয়েছে। পরিবেশ আর মানুষের সহাবস্থান বজায় রাখা হয়েছে।’

যেহেতু চারদিকের গাছগুলোর জন্য জায়গা ছেড়ে বাড়িটি বানানো হয়েছে, তাই বাড়িটির বাইরের দিকে একেক অংশে চন্দ্রাকৃতির ফাঁকা জায়গা চোখে পড়ে। যে জায়গা দিয়ে গাছগুলো আকাশের দিকে মাথা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের সঙ্গে থাকা ভিত্তির তরুণ স্থপতি সৌরভ দত্ত বললেন, এই গাছগুলোর কারণে দুটি বিশেষ সুবিধা হয়েছে। প্রথমত, গাছগুলো পরিবেশ ঠিক রাখছে আর দ্বিতীয়ত, ছাদের ওপর ডালপালা মেলে ঘরে শীতল পরিবেশ সৃষ্টি করছে।

বসার ঘরের এই অংশে টেবিল পেতে করা হয়েছে ডাইনিং এরিয়া

যেমন নকশা

পুরো বাড়িটিই খানিকটা ডিম্বাকৃতি, তাই ঘরগুলোর দরজা হয়েছে মুখোমুখি। তবে একটি রুম থেকে আরেকটির গোপনীয়তা আছে ঠিকঠাক। বাড়িটির মাঝখানে ফাঁকা রাখা হয়েছে। রোদের আলো, পূর্ণিমার চাঁদ এই খোলা আকাশ দিয়ে যেমন দেখা যায়, তেমনি আজকের দিনের বৃষ্টির ফোঁটাও হাত বাড়িয়ে অনায়াসে স্পর্শ করা যাচ্ছে। মাঝের এই খোলা জায়গাটুকুতেও বেশ কয়েকটা গাছ আছে। আমলকী, সুপারি ছাড়াও নিচে সবুজ ঘাস লাগানো হয়েছে। যেন ঘরের মধ্যেই এক টুকরা খোলা উঠান নিয়ে তৈরি হয়েছে বনের বাড়ি।

বাড়ির বাইরের দিকটা মাটির আবহ থাকলে কী হবে, ভেতরটা কিন্তু পুরোপুরি আধুনিক। কাঠের টাইলসে সাজানো মেঝে, নানা রকম আধুনিক আসবাব আর টিভি রাখা হয়েছে প্রথম ঘরে, এটা এই বাড়ির লিভিং এরিয়া। পরিবার, বন্ধুদের ছুটির সময়ে সারাক্ষণ প্রাণচঞ্চল থাকে এই ঘর। ঘরটার বাইরের দিকের প্রায় পুরো অংশে ব্যবহার করা হয়েছে স্বচ্ছ কাচ। মোটা ভারী পর্দা টেনে যেটা গোপন করা যায়, আবার দিনের বেলা পুরোপুরি সরিয়ে দিনের আলো ঘরে আনা যায়। এখানে বসে আড্ডা দিলে একটা সময় আপনি ভুলেই যাবেন, কোনো ঘরে বসে আছেন। মনে হবে, বনের মধ্যে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। এই ঘরের এক পাশে ডাইনিং টেবিল পাতা হয়েছে। পাশেই একটা ড্রাই কিচেন।

প্রাকৃতিকভাবে ঘর ঠান্ডা রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে মাটির দেয়াল

বাড়ির সদস্যসংখ্যা হিসাব করে এখানে মোট চারটি বেডরুম করা হয়েছে। প্রতিটি বেডরুমের নকশা করা হয়েছে সেই রুমের বাসিন্দার চাহিদামতো। তবে সবাই ঘর থেকে প্রকৃতি দেখতে চেয়েছেন। যে কারণে কাচের দরজা দিয়ে অবারিত করে দেওয়া হয়েছে প্রকৃতি। ইচ্ছা হলে রুমের ভেতর থেকে সেটি খুলে বাইরে বেরিয়ে আসা যায়। ঘরের ভেতরের আলো থেকে শুরু করে স্নানঘর—সবকিছুই পরিকল্পিতভাবে নকশা করে বসানো।

বাড়ির অর্ধেকটা দেখতে দেখতেই বেড়েছে বৃষ্টির ধারা। সেই বৃষ্টির সুর এখন কোরাসের মতো লাগছে।

বাইরের দিকের বারান্দায় আমরা দুপুরের খাবার খেতে বসি। সামনে খোলা বন। মেঘ–বৃষ্টির এই দুপুরে সাদা ভাতের সঙ্গে নানা রকম শাকসবজি, মাছ, মুরগির পদ। সবই এই বাড়িতে উৎপাদিত। বাড়ির একদিকে সবজির বাগান, আরেক দিকে মাছের পুকুর। আম, জাম, কাঁঠাল, চালতা, ডেউয়ার মতো নানা রকম ফলের পাশাপাশি আছে ফুলের গাছও।

বাড়িটি মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে করা হয়েছে। প্রথম দেখাতে তাই মনে হয়, ঘাসের ডগার ওপরে আলতো করে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার ওপরের ছাদটি করা হয়েছে দুই স্তরে কিছুটা ঢালু করে। দুই স্তরের মাঝে আবার দুই থেকে তিন ফুটের ফাঁক রাখা হয়েছে, যাতে বাতাস চলাচলে অসুবিধা না হয়।

ঘরগুলোর দরজা মুখোমুখি, তবে একটি রুম থেকে আরেকটির গোপনীয়তা আছে ঠিকঠাক

সৌরভ আমাদের জানালেন, সাধারণত বাড়ির জানালা সাত ফুটের বেশি দেওয়া হয় না। কারণ, এর বেশি হলে আকাশের উজ্জ্বলতা চোখে লাগে। তবে এখানে ঘন গাছপালা থাকায় সেই অসুবিধা নেই। তাই পুরোটা কাচের ব্যবহার করেও অতি উজ্জ্বলতায় চোখধাঁধানোর সুযোগ নেই। বরং প্রচুর সবুজ থাকায় আলোটা প্রতিফলিত হয়ে ভেতরে ঢোকে।

বেডরুমের ওপরে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া আলোর কারণে তাঁবুর ভেতরের আবহ পাওয়া যায়। আবার মাথার দিকে লাগানো আলোটা জ্যামিতিক নকশায় ঘরের মধ্যে এনে দেয় ভিন্ন এক পরিবেশ।

পাঁচ রুমের এই একটি বাড়ি ঘুরে দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এল। তবু বৃষ্টির থামার নাম নেই। বাধ্য হয়ে ছাতা মাথায়ই বেরিয়ে আসার তোড়জোড় করতে থাকি। এমন সময় বাড়ির সব আলো জ্বলে ওঠে। ঘন সবুজ বনের ভেতর বাড়িটাকে তখন মনে হয় দূরের এক স্বপ্নরাজ্য। গাড়িতে বসে ফেরার পথে মনে হলো, রাতটা এখানে কাটিয়ে গেলে মন্দ হতো না।