ঢাকা থেকে একটু দূরে অনেকেই গড়ে তুলছেন চোখ জুড়ানো বাড়ি, কেন

শহরে ফ্ল্যাট বা বাড়ি থাকার পরও কেন মানুষ গ্রামে বা সবুজ প্রকৃতির মাঝে আলাদা করে বাড়ি বানান, নাগরিক আরাম–আয়েশ ফেলে সপ্তাহান্তে বা ছুটির দিনগুলোতে সেখানে ছুটে যান, উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন এ কে এম জাকারিয়া

ঢাকা থেকে একটু দূরে বা নিজ গ্রামে অনেকেই এখন গড়ে তুলছেন দারুণ সব আবাস
ছবি: কবির হোসেন

মালিবাগে আমাদের একটি বাড়ি ছিল, দোতলা। এটা ছিল আমার কাছে ‘বাড়ি’। সেটি আর নেই। ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি বানানো হয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে ফেসবুকে পুরোনো সেই বাড়ির ছবি দিয়ে ছোট্ট একটি নোট শেয়ার করেছিলাম। শিরোনাম ছিল, ‘মালিবাগে এখন আর কোনো বাড়ি নেই।’ শুধু আমাদের বাড়িই নয়, সেই এলাকায় এমন আরও অনেক বাড়ি ছিল, যার একটিও এখন আর নেই। ফেসবুকে লিখেছিলাম, ‘মালিবাগের বাড়িতেই আমার বেড়ে ওঠা। এখন মালিবাগে থাকি না। তবে নিয়মিত সেখানে যাই, যাওয়ার চেষ্টা করি। কখনো আশপাশের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করি। কেন যাই? আমি আসলে এই বাড়ির টানেই মালিবাগ যাই। কিন্তু বাড়িটা খুঁজে না পেয়ে আবারও যাই। বারবার যাই।’

এখন ‘বাড়ি’তে থাকি না, ফ্ল্যাটে থাকি। এটা ফ্ল্যাট, কনডোমিনিয়ামের যুগ। এগুলোর চরিত্রও দিন দিন বদলে যাচ্ছে। সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে। বিলাসিতারও যেন শেষ নেই। সুইমিংপুল, জিম, গাছপালাসহ ট্যারেস—কত কী! কিন্তু শহরে বা গ্রামে যাঁরা বাড়িতে বড় হয়েছেন, এমন অনেককে এসব সুযোগ-সুবিধাও মন ভরাতে পারে না। কোথায় যেন একটা নেই নেই হাহাকার থেকে যায়। এমন অনেকেই বাড়ির খোঁজে থাকেন, বাড়ির স্বপ্নকে ধরে রাখেন।

ছুটি কাটানোর বাড়িগুলো স্থাপত্যের দিক থেকেও শৈল্পিক হয়

এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পশ্চিমের বা অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলো অনেক আগেই গেছে। শহরের জমির দাম সবখানেই আকাশছোঁয়া। উঁচু উঁচু দালানের ভিড়ে সেখানে বাড়ি রাখার সুযোগ অনেক আগেই নষ্ট হয়েছে। সেখানকার শহুরে মানুষের কাছে ফার্ম হাউস, হলিডে হোম বা কটেজ, পুরো কাঠ দিয়ে তৈরি লগ হাউস—এসবের ধারণা বেশ পুরোনো। সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে তাঁরা শহরে থাকেন আর উইকেন্ড বা যেকোনো ছুটি কাটাতে অনেকেই ছোটেন ফার্ম হাউস বা হলিডে হোমে। এর সঙ্গে অবশ্যই সামর্থ্যের বিষয়টি জড়িত রয়েছে। আমাদের দেশের সামর্থ্যবানেরাও এখন সেই পথে হাঁটতে শুরু করেছেন।

তবে এই ধারণা যে পশ্চিম বা উন্নত বিশ্ব থেকে ধার করা, এমন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আমাদের দেশের রাজা-বাদশাহ, জমিদার বা বিত্তবানদের মধ্যে ‘বাগানবাড়ি’র সংস্কৃতি বেশ পুরোনো। চিত্রকর, নন্দনতাত্ত্বিক ও শিশুসাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর ধারে বইয়ে কলকাতার কাছেই হুগলি জেলার কোন্নগরে ঠাকুরদের বাগানবাড়ির বর্ণনা পাই। লিখেছেন, ‘কোন্নগরে কী আনন্দেই না কাটাতুম!’ এই বাগানবাড়িতে বসেই কুঁড়েঘর আঁকতে শিখেছিলেন এই চিত্রশিল্পী। গঙ্গার তীরে প্রায় ১৩ বিঘা জমির ওপর ১৮৭০ সালে এই বাগানবাড়ি তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ঢাকার কাছেই একটি বাগানবাড়ি

ঠাকুর পরিবারের এই বাগানবাড়ির সঙ্গে অবশ্য অন্য অনেক জমিদারের বাগানবাড়িকে মেলানো যাবে না। জমিদারদের বাগানবাড়ি অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের নানা জমিদারি অভ্যাস, বদভ্যাস বা খায়েশ পূরণের কাজে লাগত। আজকের যুগের ‘হলিডে হোম’ সেই বাগানবাড়ির ধারাবাহিকতা হলেও চরিত্রের দিক থেকে বলা যায় পুরোটাই পাল্টে গেছে। কলকাতার বিত্তবান ও সংস্কৃতিমান অনেকেরই এখন হলিডে হোম আছে শান্তিনিকেতনে। আমাদের লেখক হুমায়ূন আহমেদ সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বাঁশের বেড়া আর টিনে একেবারেই অনাড়ম্বরভাবে যে ‘সমুদ্রবিলাস’ গড়ে তুলেছিলেন, সেটাও ওই হলিডে হোমের ধারণা থেকেই। জায়গার সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য, গাছপালা, প্রকৃতি ও পরিবেশ—এসবই হলিডে হোমের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কতটা বিলাসবহুলভাবে তৈরি হলো, তা নয়।

ঢাকার ফ্ল্যাটবাসী বিত্তবান, এমনকি মধ্যবিত্তরাও এখন নিজের এমন একটি বাড়ির খোঁজে সামর্থ্য অনুযায়ী হলিডে হোম বা ‘ছুটির দিনের আবাস’ তৈরির দিকে ঝুঁকেছেন। সাপ্তাহিক বা যেকোনো ছুটিতে সেখানে যাওয়া ও আবার কাজে ফেরার সুবিধা বিবেচনায় ঢাকার আশপাশই তাঁদের পছন্দ। আর ঢাকার আশপাশেই যাঁদের ‘গ্রামের বাড়ি’, তাঁদের জন্য অবশ্য কাজটি একেবারেই সহজ হয়ে গেছে। যাতায়াতব্যবস্থার উন্নতির কারণে ঢাকা থেকে কিছুই আর এখন খুব দূরে নয়। সামর্থ্য যাঁদের আছে, তাঁরা নিজেদের গ্রামের বাড়িতেই আধুনিক সুযোগ–সুবিধাসহ থাকার উপযোগী কিছু না কিছু করছেন, যেগুলো আসলে হলিডে হোমের মতোই। বলা যায়, নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল নয়; বরং দেশজুড়েই এর বিস্তার ঘটছে।

অবসর কাটাতে ছুটির দিনগুলোতে পরিবার নিয়ে অনেকেই হলিডে হোমে যান

হলিডে হোম বা এ ধরনের কিছু করার জন্য অবশ্যই সামর্থ্য লাগে, কিন্তু শখের বিষয়টি সম্ভবত এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই হলিডে হোমগুলো স্থাপত্যের দিক থেকে হয়ে ওঠে শৈল্পিক, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও অনন্য। নিজের রুচি অনুযায়ী তাঁরা একে সাজাতে চান। গাছপালা, অন্দরসজ্জা বা আসবাব—এসবের মধ্য দিয়ে যাঁর যাঁর নিজস্ব পছন্দ–রুচি ফুটে ওঠে।

সাধারণভাবে হলিডে হোমের ধারণাটি বাণিজ্যিক নয়। নিজের ও পরিবারের কথা বিবেচনায় রেখেই তা বানানো হয়। তবে নিয়মিত বন্ধুবান্ধবকে আমন্ত্রণ জানানো ও তাঁদের সঙ্গে সময় কাটানোর যে আনন্দ, তার তুলনা নেই। আপনার শহরের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব নিশ্চয়ই নিয়মিতই আসা-যাওয়া করেন। কিন্তু আপনার হলিডে হোম থাকলে সেখানে তাঁদের নিমন্ত্রণ করে দেখেন, সারা দিন তাঁদের সঙ্গে কাটান, অতিথিদের কাছে এটা এক মজার স্মৃতি হয়ে থাকবে।

আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে এখন ঘুরতে যাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। সাপ্তাহিক বা যেকোনো ছুটিতে তাঁরা কোথাও না কোথাও যেতে চান। এমন অনেকেই আছেন, প্রতি সপ্তাহেই যাঁরা ঢাকা থেকে বের হতে চান, একটু প্রকৃতির কাছে, একটু খোলামেলা জায়গায় যেতে চান।

কিন্তু প্রতি সপ্তাহে পছন্দের একটি জায়গা খুঁজে বের করা, সেখানে যাওয়ার উদ্যোগ আয়োজন করা—মোটেও এসব সহজ কাজ নয়। আবার নতুন একটি জায়গায় গিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা ভালো না–ও হতে পারে। আপনার রুচির সঙ্গে যদি না মেলে, তাহলে ছুটির দিনটি বা দিনগুলোই মাটি। হলিডে হোম এসব যন্ত্রণা থেকে আপনাকে মুক্তি দেবে। নিয়মিতই আপনি ছুটি কাটাতে পারবেন নির্ঝঞ্ঝাট।

বিনিয়োগ হিসেবে দেখলেও হলিডে হোম একটি ভালো বিনিয়োগ। আমাদের দেশে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে যার দাম বাড়ে, তা হচ্ছে জমি। আপনি এখন যে দামে ঢাকার আশপাশে জমি কিনে এমন কিছু বানাবেন, বছর দশেক উপভোগ করার পর দেখবেন দামও কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।

এখন যা হলিডে হোম, তাকে আপনি আপনার অবসরজীবনের আবাস হিসেবে কাজে লাগানোর পরিকল্পনাও করতে পারেন। শহর ছেড়ে তখন উঠে যেতে পারবেন এই হলিডে হোমে। এটাই হয়ে উঠবে আপনার বাড়ি। প্রকৃতির কাছাকাছি, তুলনামূলক কম বায়ু ও শব্দদূষণে, গাছগাছালির পরিবেশ আপনার অবসরজীবনকে করে তুলতে পারে অর্থপূর্ণ ও শান্তিময়।

করোনার সময় ছুটি কাটানোর এসব বাড়ি আমাদের অনেকেরই আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। সবকিছু থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন ও একই সঙ্গে প্রকৃতির খোলামেলা পরিবেশে থাকা গেছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে পড়ে জোড়াসাঁকোর জন্মভিটা ছেড়ে প্রথম বাগানবাড়িতে গিয়েছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথ। জীবন-স্মৃতিতে তিনি লিখেছেন, ‘একবার কলিকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের তাড়ায় আমাদের বৃহৎ পরিবারের কিয়দংশ পেনিটিতে ছাতুবাবুদের বাগানে আশ্রয় লইল। আমি তাহার মধ্যে ছিলাম। এই প্রথম বাহিরে গেলাম। গঙ্গার তীরভূমি যেন কোন পূর্বজন্মের পরিচয়ে আমাকে কোলে করিয়া লইল।’ রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ১২, সময় ১৮৭২ সাল। গঙ্গার তীরে পানিহাটি বা পেনেটির ‘মোক্ষধাম’ নামের এই বাগানবাড়ি তখন মালিকের কাছ থেকে ঠাকুর পরিবার অর্থের বিনিময়ে ভাড়া নিয়েছিল। বাগানবাড়ির প্রকৃতি ও পরিবেশ বালক রবীন্দ্রনাথের জীবনে কী প্রভাব ফেলেছিল, তা তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখায় লিখেছেনও।

শুধু সামর্থ্য থাকলেই যে কেউ হলিডে হোম ধরনের কিছু করেন, এমন নয়। এটা ব্যক্তিবিশেষের রুচি ও জীবনে কার কোন চাওয়া-পাওয়াটি গুরুত্বপূর্ণ, তার ওপর নির্ভর করে। একটি হলিডে হোম বানিয়ে ফেলার চেয়ে এর রক্ষণাবেক্ষণ বা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, গাছপালার পরিচর্যা ও যত্ন নেওয়ার কাজটি বেশি কঠিন। নিজের তদারকি ছাড়া শুধু তত্ত্বাবধায়কের ওপর ভরসা করে কাজটি হয় না।

কাজের চাপে কখনো আপনার যাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়তে পারে। বাড়িতে মানুষ না থাকলে সেই বাড়ি দ্রুত থাকার অনুপযোগী হয়ে ওঠে। এসব বিবেচনায় অনেকেই ভাবেন, পয়সা খরচ করলেই তো প্রকৃতির কাছাকাছি সব ধরনের সুযোগ–সুবিধাসহ নানা ধরনের রিসোর্টে গিয়ে থাকা যায়, নিজে ঝামেলা করে এমন কিছু বানানোর যুক্তিটা তাহলে কী!

আরাম, আয়েস, চাহিবামাত্র সার্ভিস, অর্থের বিনিময়ে সবই হয়তো সেখানে পাওয়া যায় সত্যি, কিন্তু নিজের বাড়িতে ফেরার শান্তিটা পাওয়া যায় না। আর শেষ পর্যন্ত আমরা তো বাড়িতে ফিরতে চাই, নাকি?