বেত এবং বাঁশের তৈরি অনুষঙ্গের আছে নিজস্ব সৌন্দর্য।
বেত এবং বাঁশের তৈরি অনুষঙ্গের আছে নিজস্ব সৌন্দর্য।

ঘর সাজাতে ও প্রতিদিনকার ব্যবহার্য পণ্যে ফিরে এল বাঁশ–বেত

নতুন রূপে ফিরে বাঁশ আর বেত। বাড়ি সাজানো থেকে শুরু করে প্রতিদিনকার ব্যবহার্য পণ্য বানানো হচ্ছে এই দুই উপকরণ দিয়ে।

যে কুলায় ধান বাছেন বা মাছ কাটেন গ্রামের বধূ, সেটাই একসময় শহুরে বসার ঘরের দেয়ালে ঝুলে হয়ে ওঠে অন্দরসজ্জার উপকরণ। যে বেত বা বাঁশের ঝুড়ি গ্রামে নিত্যদিনের জিনিস বহন করার মাধ্যম, সেটাই শহরে এসে হয়ে গেছে গাছের টব বা লাইটের শেড। এভাবে গ্রামের নিত্যব্যবহার্য বাঁশ আর বেত ধীরে ধীরে কিছুটা ভিন্নভাবে শহুরে জীবনে ঢুকে পড়েছে। বাড়ির অন্দরসজ্জায় বাঁশ–বেতের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই ছিল। তবে মাঝে জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছিল বেশ। গত কয়েক বছরে অন্দরসজ্জায় আবার চোখের পড়ার মতো করে ফিরে এসেছে বাঁশ–বেত। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পাশ্চাত্যেও এখন বাঁশ আর বেতের জনপ্রিয়তা চোখে পড়ার মতো।

কাঠের চেয়ারের সঙ্গে বেতের জালি জুড়ে দিলেই চলে আসে নতুন ছন্দ

বাঁশ–বেত আমাদের দেশে আবহমানকাল থেকেই আছে। সিলেটে তো বাণিজ্যিকভাবেই বেতের চাষ করা হয়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাওয়া যায় বেতগাছ। অন্যদিকে আমাদের দেশে ৩০টির বেশি প্রজাতির বাঁশ পাওয়া যায়। সিলেট অঞ্চলে বেশি দেখা যায় তল্লা, মাকলা ও করজবা বাঁশ। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাইজ্জা, যশোর ও খুলনা অঞ্চলে বরাক আর ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাওয়া যায় ভুদুম বাঁশ। প্রায় সারা দেশেই আছে মুলি বাঁশ।

বাঁশের টেবিল ল্যাম্প

মুলি বাঁশ, তল্লা বাঁশ ও বইরা বাঁশ দিয়ে কুমিল্লা, পাবনা, মাদারীপুর, মধুপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, রংপুর, রাঙামাটিতে বানানো হয় বিভিন্ন হাতের জিনিস, জানালেন স্থপতি ও ভূমি আর্টিসানের স্বত্বাধিকারী জান্নাতুল ফেরদাউস। জালি আর গোল্লা বেত দিয়ে বানানো হচ্ছে চেয়ার, টেবিল, ঝুড়ি, দোলনা ও বাড়ির নানা অনুষঙ্গ।

কাপড় ঝোলানোর ছোট হুঁক থেকে বিছানার হেডবোর্ড, নানা অনুষঙ্গেই ব্যবহৃত হচ্ছে এ দুটি উপকরণ। আবার কখনো বাঁশ আর বেতের সঙ্গে মেলানো হচ্ছে মাটি, কাঠ ও ধাতব উপকরণ। অন্দরসজ্জার অনুষঙ্গ পাওয়া যায়, এমন দামি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সূক্ষ্ম কাজের মাধ্যমে অভিজাত রূপও দেওয়া হচ্ছে। তবে বাঁশ আর বেতের প্রাকৃতিক ভাবটা বজায় রাখলেই মূল সৌন্দর্যটা ফোটে ভালো।

বাঁশ ও বেতের তৈরি গাছ রাখার ঝুড়ি

প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া এ দুটি উপকরণ মানসিকভাবে প্রশান্তি দেয়, এমনটাই মনে করেন গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান সালমা পারভীন। এ কারণে তাঁর কাকরাইলের বাড়িতে বাঁশ–বেতের ব্যবহারও চোখে পড়ার মতো। খাবার টেবিলের ডিনার ওয়াগনের দরজায় কাঠের ফ্রেমে জুড়ে দিয়েছেন বেতের জালি। বিছানার হেডবোর্ডেও একই কাজ করেছেন।

ডিনার ওয়াগনে এভাবে জালি আটকে দেওয়া যায়

মার্কিন মুলুক কিংবা ইউরোপের ফ্রান্স, ইতালি—সব জায়গাতেই জনপ্রিয় এখন এ পদ্ধতি। সালমা পারভীনের মতে, বাঁশ বা বেত সহজে নষ্ট হয় না। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়। কোথাও যদি ফেলেও রাখা হয়, দেখবেন যে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে না। সহজে পরিষ্কার করা যায়। রং জ্বলে গেলে বার্ণিশ করে নিলেই হলো। নতুন করে ফেরত পাবেন পুরোনো চেহারা।

পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়েই কাজ করতে চাইছিলেন স্থপতি এবং অনলাইনভিত্তিক দোকান ভূমি আর্টিসানের স্বত্বাধিকারী জান্নাতুল ফেরদাউস। তিনি বলেন, বাঁশ–বেতের চেয়ে দেশীয় ও পরিবেশবান্ধব আর কী আছে। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। অন্য গাছ কেটে ফেললে তখন আর সেটা পরিবেশবান্ধব থাকে না। কিন্তু বাঁশ আর বেত কেটে ফেললেও গোড়া থেকে আবার অঙ্কুরোদ্‌গম হয়। প্রায় তিন বছর ধরে এ দুটি উপকরণ নিয়ে কাজ করছে ভূমি আর্টিসান। গাছ রাখার প্ল্যান্টার দিয়ে শুরু হয়েছিল। এখন টেরাকোটার ক্রোকারিজেও ব্যবহৃত হচ্ছে বাঁশ। মাটির সঙ্গে বাঁশের এই মিশ্রণ দিচ্ছে ভিন্ন আমেজ। তারা আরও বানাচ্ছে বাঁশ আর বেতের ল্যাম্পশেড, শুকনা খাবার পরিবেশনের ট্রে, ঝোলানো ল্যাম্পশেড, ঝুড়ি, টেবিল ল্যাম্পশেড, ট্রে, প্লেট রাখার স্ট্যান্ড ইত্যাদি।

মাটির সঙ্গে বাঁশের কাজ

ইশোর প্রধান আর্কিটেক্ট পিণাকপাণি সাহা বলেন, ‘আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী—দুটো অনুভবই দেয় বেত। এটা এমন একটা উপকরণ, যেটা আধুনিক বাড়িতে যেমন মানাবে, আবার ঐতিহ্যবাহী বাড়ির অন্দরসজ্জাতেও নিজের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরবে।’ অনেক সময় পুরো আসবাব বেতের হলে একঘেয়ে ভাব চলে আসে। বনেদিয়ানা, আধুনিকতা, আভিজাত্য—তিনটি ভিন্নতাই নিয়ে আসবে বেতের সঙ্গে কাঠের ব্যবহার। কাঠের চেয়ারে যদি গাঢ় রঙের বার্ণিশ আর বেত থাকে, পুরোনো আমলের বনেদিয়ানা ভাব চলে আসবে। একই চেয়ার যদি উজ্জ্বল কমলা বা নীল রং করে দেওয়া হয়, চলে আসবে আধুনিক ধাঁচ। যেসব চেয়ার শুধু কাপড়ে মোড়ানো হয়, সেখানেও বেতের কিছুটা ব্যবহার করতে পারেন। আবার বেতের চেয়ারে জুড়ে দিতে পারেন ভেলভেটের কাপড়। চেয়ারের নিচে লাগাতে পারেন পিতলের ছোট পায়া। সাধারণ বেতের জালির সঙ্গে যখন কাঠের ফ্রেম বা ধাতব উপকরণ যোগ-বিয়োগ করা হয়, পাল্টে যায় ঝুড়ি বা প্ল্যান্টারের চেহারা। জানালাজুড়ে বাঁশের চিক সব সময়ই জনপ্রিয় ছিল, আছে, থাকবে।

মাটির সঙ্গে বাঁশের কাজ

সব সময় পানি বা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে না রাখলে বাঁশ, বেতের জিনিস টিকে থাকবে বছরের পর বছর। বেত আর বাঁশের জিনিসগুলোকে টেকসই করার জন্য দেওয়া হচ্ছে উন্নত মানের ট্রিটমেন্ট। খাবারের সংস্পর্শে আসবে, এমন পণ্যগুলোতে দেওয়া হচ্ছে হারবাল ট্রিটমেন্ট। বাড়ির বাইরে ব্যবহার করা হবে, এমন পণ্যগুলোতে দেওয়া হচ্ছে রাসায়নিক ট্রিটমেন্ট।

গাছ রাখার প্ল্যান্টার

অন্যদিকে একেক ধরনের বেতের জিনিসে দেওয়া হচ্ছে একেক ধরনের বুনন। সাধারণত ব্যবহারিক প্রয়োজন থেকেই এসেছে এসব বুনন। ঘরের চাল থেকে এসেছে চালা বুনন, মাচা থেকে মাচা বুনন, ঘরের বেড়া থেকে যে বুনন করা হয়, তা বেড়া বুনন নামে পরিচিত। বেতের ট্রে করতে প্রয়োজন হয় এই বুনন। এই বুননে কোনো ফাঁকা থাকে না। অন্যদিকে ল্যাম্পশেডে দেওয়া হয় চালন বুনন। এই বুননের ফাঁক দিয়ে আলো যাওয়া–আসা করতে পারে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, দেশের বাইরে এ দুটি উপকরণের চাহিদা এখন ব্যাপক। ব্যাগ, টেবিল সাজানোর ম্যাট, গয়না, স্ট্যান্ড, দোলনা, ছবির ফ্রেম ইত্যাদি জিনিস বেশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারাও নির্দ্বিধায় কিনছেন। জানেন, এ উপকরণের পণ্য ব্যবহার করা যাবে সারা জীবন। বাঁশ, বেতের সৌন্দর্য কখনো হারিয়ে যায়নি, ভবিষ্যতেও মলিন হবে না।