মেরামেরির ঘর কি জানেন

বাস থেকে নেমে মনে হলো নিশুতি রাত। সুনামগঞ্জ শহর থেকে বেশ দূরে বাণিপুর গ্রাম, একদম অজপাড়াগাঁ। সেখানেই যাব আমরা। শীতে জবুথবু গুদারা ঘাটে গিয়ে দেখি, মাঝিরা নৌকা রেখেই বাড়িতে চলে গেছেন। এখন ঘোরা পথে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। অনেক কষ্টে এক টমটমওয়ালাকে রাজি করাল সীমান্ত। কাঁচা রাস্তা ধরে নদীর পাড় দিয়ে চলছে টমটম। শীত যেন আমাদের জাপটে ধরেছে। দুই-তিন স্তর গরম কাপড়েও শীত মানছে না।

মেরামেরির ঘর
ছবি: লেখক

কয়েকটি গ্রাম পেরিয়ে আমরা এলাম মুড়ারবন্দে। এত রাতে কে যায়? এ রকম ভাব নিয়ে কেউ কেউ অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন। রাস্তার পাশের বাড়িঘরে আলো নিভে গেছে। পরিষ্কার আকাশে মিটিমিটি তারা জ্বলছে, তার মধ্যে একফালি বাঁকা চাঁদ ঝুলে আছে। রাত ১১টার দিকে আমরা বাণিপুরে পৌঁছালাম।

নদীর পাড়েই শুভ-সীমান্তর মামার বাড়ি। শীতের পিঠার স্বাদ নিতে পৌষসংক্রান্তির নিমন্ত্রণে আমরা হাজির হচ্ছি। বাড়ির কাছে গিয়ে দেখি, একটু পরপর বালুবাহী নৌকা চলে যাচ্ছে। গ্রামের জেলেরা টর্চ মেরে ফলা হাতে মাছ খুঁজছেন। মামাবাড়িতে ঢুকতেই দেখি উঠানটা আদর করে লেপে রেখেছেন কেউ। উঠানে আবীর দিয়ে, চালের গুঁড়ি দিয়ে আঁকা হয়েছে আলপনা।

শহুরে ভাগনেদের আসার খবর শুনে পাড়ায় ভিড় জমে গেল। পিঠাপুলি আর গরম চা দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করা হলো। চারদিকে সাজ সাজ রব। আমাদের জন্য হাঁসের মাংস আর বিলের মাছ রান্না হলো। বড় থালায় গরম-গরম ভাতের সঙ্গে নানা পদের খাবার।

শুভর মামা গৌরমোহন দাশ এই গ্রামেই বড় হয়েছেন। ভাগ্য ফেরাতে ওমানে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মন সব সময় এই সুরমাপাড়ে পড়ে ছিল। পৌষসংক্রান্তির গল্প উঠতেই তিনি শৈশবের স্মৃতিচারণা করলেন। সারা রাত নাড়া দিয়ে ঘর বানিয়ে ভোরে সেই ঘর পুড়িয়ে ফেলতেন, শৈশবের দৃশ্যপট এখনো জ্বলজ্বল করছে। হুট করেই মামাকে বললাম, ‘চলেন, আজ আবার ঘর বানাই।’

পিঠা ছাড়া কি আর শীতকাল জমে?

শহর থেকে সবাই শীত উদযাপন করতে শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গ্রামে এসেছেন। আমার প্রস্তাবে কেউ কেউ কপাল কোঁচকাল। কিন্তু আমি আর মামা, রাত ১২টায় দা আর করাত নিয়ে বাঁশঝাড়ে চলে গেলাম। মাঝরাত্তিরে আমাদের পাগলামো দেখে বাঁশঝাড়ের ভূতেরাও বোধ হয় অবাক হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত একে একে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

নদীর পাড়ে রাত জেগে এক ঘণ্টায়ই তৈরি করে ফেললাম মেরামেরির ঘর। বিভিন্ন এলাকায় এর বিভিন্ন নাম। কেউ বলেন বুড়ির ঘর, কেউ বলেন নাড়ার ঘর, আবার কেউ বলেন বেড়াবেড়ির ঘর। মহাভারত–এও নাকি আছে মেরামেরি ঘরের উল্লেখ।

মহাভারত–এর অনন্য চরিত্র ভীষ্মের ছিল ইচ্ছামৃত্যুর শক্তি। উত্তরায়ণ আসার আগে শরশয্যায় ৫৮ দিন কাটিয়ে পৌষসংক্রান্তিতে তিনি দেহত্যাগ করেন। তাঁর স্মরণেই নাকি তৈরি হয় মেরামেরি ঘর।

ঘর তৈরি করে আমরা বজরায় চেপে বসলাম। সারা রাত ঢোলের তালে বাউলগান হলো। নেশাতুর নয়নে ভোর হলো। সুরমাপাড়ে মেরামেরি ঘরে আগুন জ্বালানো হলো। গাঙের জলে যেন ভেসে আছে কুয়াশার দলা। কুসুমরঙা সূর্য উঠল, তার মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলছে ঘর। আমরা আগুন পোহালাম। ঘর থেকে রসে টইটম্বুর মিষ্টি পিঠা পাঠালেন নানি। পিঠা খেয়ে কয়েকজন এই ঠান্ডায়ই নদীতে পুণ্যস্নানে নেমে গেল। শীতল বাতাসে নিস্তব্ধ চারদিক। সে এক অপার্থিব দৃশ্য! আমার হাসন রাজার গানটার কথা মনে পড়ছে, ‘কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার।’