আবাসিক এলাকা হলেও আকাশছোঁয়া সব আবাসনের কারণে ধানমন্ডিতে এখন খোলা আকাশ কম। এরই মধ্যে এখনো দোতলা, তিনতলা হাতে গোনা কয়েকটি বাড়ি ‘ঠিকই টিকিয়া রহিয়াছে’। টিকে থাকলেও রাস্তা বাদে তিন দিকে বহুতল ভবনের চাপে একসময়ের অভিজাত বাড়িগুলোর এখন চিড়েচ্যাপটা দশা।
এর মধ্যেও ব্যতিক্রমী এক বাড়ি ‘টাইগার ডেল’। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরের এক কোণের এই বাড়িতে থাকেন স্থপতি নাহাস আহমেদ খলিল এবং সাবেক ব্যাংকার জায়তুন সায়েফ রূপা দম্পতি।
টাইগার ডেলের নিচতলাটা অরণি বিদ্যালয়। ছোটদের এই স্কুলটা প্রতিষ্ঠা করেছেন নাহাস–জায়তুন দম্পতি। জায়তুন জানালেন, অঙ্কুর, কলি ও কুসুম—অরণির প্রাক্–প্রাথমিক শ্রেণিগুলো এখানে। শিশুদের কলকাকলিতে সকালটা মুখর থাকে। স্কুলের অংশটা আলাদা। তাই রাস্তা থেকে টাইগার ডেলের ঢোকার অংশটা দেখলে লতা–গুল্ম, গাছপালায় ভরা এক গাড়িবারান্দাই চোখে পড়ে। গাড়িবারান্দার ওপর দোতলায় দেখা যায় সাবেকি আমলের মোজাইকের রেলিং দেওয়া বারান্দা। তিনতলাটাও চোখে পড়ে। গাছগাছড়ায় ঘেরা এক বাড়ি, এমনটাই মনে হয়।
নাহাস খলিলের প্রয়াত বাবা মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান ১৯৬৩ সালে বাড়িটি করেছিলেন, প্রথমে ছিল একতলা। নাহাস বলেন, ‘তখন ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় জমি বরাদ্দ, বাড়ি নির্মাণ সবে শুরু হয়েছে। আমার মামা ও বাবা মিলে লাগোয়া এক বিঘার প্লট। আমাদের বাড়িটা করা হয়েছে ১০ কাঠা জমির ওপর। আমরা তিন ভাই, এক বোন এ বাড়িতেই বেড়ে উঠেছি। নিচতলায় (এখন যেখানে অরণি বিদ্যালয়) থাকতাম আমরা। ১৯৭৮ সালে তৈরি হয় দ্বিতীয় তলা।’
সেই সময়ের বাড়ি যেমনটা হয়ে থাকে, শুরুতে বাড়িটি তেমন সাদামাটাই ছিল। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে স্নাতক হন নাহাস খলিল। ১৯৮৭ সালে বিয়ে। আরও কয়েক বছর পর নির্মাণ করা হয় তিনতলা। এই তলাটার নকশা করেন স্থপতি নাহাস খলিল।
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পর বাঁ দিকে টেরেস। গাড়িবারান্দার ছাদ। পুরোটাই যেন বাগান। নানা রকমের গাছ। নাহাস বললেন, ‘বাগান করা আমাদের শখ। আর আমরা একটু বুনো গাছ পছন্দ করি। মালি আছে, সপ্তাহে দু–তিন দিন এসে দরকারি পরিচর্যা করে দেন। গাছের পানি দেওয়ার কাজটা আমি ও রূপা (স্ত্রী জায়তুন সায়েফ) করি।’ এ জায়গায় দাঁড়ালে হঠাৎই মনে হবে, ব্যস্ত নগর থেকে একটু যেন আড়াল। এমনিতে এ বাড়ির চৌহদ্দিতে নারকেল, কৃষ্ণচূড়াসহ কিছু বড় গাছ রয়েছে। ফলে ছায়াঘেরা স্বস্তি বিরাজ করে সব সময়।
চলুন, এবার অন্দরে ঢোকা যাক। তিন আর চারতলার একটা ঘর মিলিয়ে নাহাস খলিলদের বাস। তিনতলায় ঢুকতেই বাঁয়ে দেখা গেল টবে ফুটে আছে কমলারঙা বার্ডস অব প্যারাডাইস। এ তলায় বসার ঘর ও খাবার জায়গা মেলানো, একটি শোবার ঘরও আছে। বসার জন্য বেত, কাঠের আসবাব। জায়তুন জানালেন, দু–একটি বেতের আসবাব ষাটের দশকের। বসার জায়গাটার পেছনে ইটের দেয়াল। সাধারণ খোলা ইট। নাহাস বলেন, বাড়ি ইটের ভিত্তির ওপর নির্মিত। তাই নিচে যেখানে দেয়াল, সেই বরাবরই দেয়াল করা হয়েছে। নাহলে ওপরে ভারসাম্য রাখা যায় না।
এই বসার জায়গার একদিকে বড় জানালা। কোনো গ্রিল নেই। কাচের জানালা খুলে দিলেই ভিতর–বাহির এক হয়ে যায়। বসার ঘরের ইটের দেয়ালের পেছনে একটু খোলা জায়গা। সেখানে গার্ডেন টেবিল–চেয়ার পাতা। যথারীতি ছোট ছোট গাছ রয়েছে।
বসার আর খাবার ঘর থেকে চারতলায় উঠে গেছে প্যাঁচানো সিঁড়ি। তিন ও চারতলা মিলে ডুপ্লেক্স। খাবার টেবিলকে পাশ কাটিয়ে যে সিঁড়িটা উঠে গেছে, সেটি এমনিতেই আলোকিত। ব্যাখ্যা দিলেন নাহাস খলিল, খাবার ঘরের অংশটায় কোনো জানালা নেই। তাই সিঁড়ি দিয়ে আলো আনা হয়েছে। সিঁড়ির ওপরে কাচের ব্লক ব্যবহার করা হয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠেই শোবার ঘর। আর আছে স্নানঘর। নাহাস খলিল বললেন, ‘আমরা কৃষ্ণচূড়ার নিচে গোসল করি।’ মানে? স্নানঘরের যে জায়গাটায় শাওয়ার, তার ওপরের ছাদে বসানো হয়েছে কাচ। সেই কাচের ওপর ঝুঁকে আছে কৃষ্ণচূড়া। সেটা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
নাহাস খলিলদের বাড়ির চারপাশে অনেকগুলো বহুতল আবাসিক ভবন। তারপরও কিন্তু এ বাড়িতে আলো–বাতাসের অভাব নেই। নাহাস জানালেন, ‘আমাদের দেশে বাতাস খেলে দক্ষিণ–পূর্ব কোণ থেকে। ধানমন্ডি লেকের রবীন্দ্র সরোবর বাড়ির সামনের দিকটা অনেকটাই অবারিত করে দিয়েছে। আর সেদিক থেকে বাতাস খেলে বেশ।’
নাহাস খলিলদের স্থাপত্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির নাম আর্ক আর্কিটেকচারাল কনসালট্যান্টস। এই বাড়িরই কয়েক তলার ফাঁকফোকরে তার অফিস। সে বেশ মজার সমন্বয়। তিনতলার একটা অংশে যেমন আছে কাজের জায়গা, সভাকক্ষ; তেমনি আড়াই তলা–সাড়ে তিনতলায় বেশ গোছানো কাজের জায়গা। যাতায়াতের জন্য আছে কাঠের সিঁড়ি। কাজের জায়গাগুলোও খোলামেলা।
নিজের থাকার বাড়ি তৈরির সময় কী কী ভাবনা কাজ করেছে? নাহাস খলিল বলেন, ‘একটু পেছন থেকে বলি। ১৯৮২ সালে আমরা যখন স্থাপত্য বিভাগ থেকে পাস করলাম, তখন তো ইন্টারনেট ছিল না। স্থাপত্যের নমুনা বা উদাহরণ ম্যাগাজিনে ছাপা হতো। সেগুলো বিদেশি। অন্য সংস্কৃতি, ভিন্ন দেশের স্থাপত্যকর্ম।
সেই সময় স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে কেন্দ্র করে চেতনা নামে একটি পাঠচক্র গড়ে ওঠে। সেখানে আমরা উপলব্ধি করলাম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বাস্তব স্থাপত্যচর্চায় খুব একটা কাজে লাগছে না। মাজহারুল ইসলাম বললেন, আমাদের নিজেদের প্রাইড বাড়াতে হবে। গর্ব না থাকলে নকশায় নিজস্বতা পাওয়া যাবে না। আমাদের এখানে যেসব স্থাপত্য, সেগুলো তো ইংরেজদের নকশা। আমাদের দেশ–সংস্কৃতি না বুঝেই সেগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। স্থাপত্য নকশায় আমাদের নিজেদের কিছু একটা থাকতে হবে। কী হতে পারে তা? গ্রামের প্রতিটি বাড়ির সামনে একটা স্পেস থাকে। যেখানে ছায়া আছে, কিন্তু দেয়াল নেই। এই প্যাভিলিয়ন সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এটা আসলে ভেতর আর বাইরের অংশকে এক করে। ওই ভাবনা থেকেই ১৯৯৪ সালে ডুপ্লেক্স করা। অন্দর ও বাহির স্পষ্ট কোণে রেখা দিয়ে ভাগ করে নয়।’
টাইগার ডেলে কিছুক্ষণ বসলেই বোঝা যায়, অন্দর–বাহির, প্রকৃতি সব একাকার। নাহাস–জায়তুন দম্পতির চিত্রকলার প্রতি বিশেষ টান, ঘরের দেয়ালে অনেক চিত্রকর্ম। আছে কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ কিবরিয়া, পূর্ণেন্দু পত্রী, যোগেন চৌধুরী, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, হাশেম খান, মনিরুল ইসলাম, আবদুল মুক্তাদির, মোমেনুর রেজা, জি এস কবির, কাজী গিয়াসউদ্দিন, হামিদুজ্জামান খান, আবুল বার্ক্ আলভী, ওয়াকিল আহমেদসহ আরও কয়েকজন শিল্পীর কাজ। আর ঘরভরা নানা রকমের মুখোশ। নাহাস–জায়তুন দম্পতি গানবাজনা পছন্দ করেন বেশ। জায়তুন বললেন, ‘নিজেরা গান করতে পারি না। কিন্তু দুজনেরই গান শুনতে ভালো লাগে। মাঝেমধ্যেই বাসায় বসে গানের আসর।’
অন্দরসাজে বা বিভিন্ন কিছুর সংগ্রহে কার পছন্দ প্রাধান্য পায়? জায়তুন বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের দুজনের পছন্দ মিলে যায়। আর কাছাকাছি পছন্দ হলে আমরা মেনে নিই। নাহাস এ ব্যাপারে প্রফেশনালি ট্রেইনড। তাই তার পছন্দকে প্রাধান্য দিই।’
নাহাস খলিলের মা–বাবা গত হয়েছেন বেশ আগেই। দোতলায় মায়ের ঘরটা সে রকমই রেখেছেন। দোতলায় আরও দুটি ঘর রয়েছে। নাহাসের দুই ভাই বর্তমানে প্রবাসী। তাঁরা দেশে এলে দোতলায় থাকেন। বাকিটা সময় ফাঁকাই থাকে। ঢাকাতেই, অন্য বাড়িতে থাকেন বোন।
বাড়ির নাম টাইগার ডেল কেন? নাহাস বললেন, ‘এর একটা ইতিহাস আছে। আব্বা (মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান) যখন সেনাবাহিনীতে কর্মরত, তখন ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি আর্মিতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল না। জেনারেল এম এ জি ওসমানী (মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক), আব্বাসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করার দাবি জানান। তাঁদের বিভিন্ন দক্ষতার প্রমাণ দেওয়ার পর গঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন “সিনিয়র টাইগার” নামে পরিচিত ছিল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা পরে ধানমন্ডিতে বাড়ি করেন। সেগুলোর নামের সঙ্গে তাই বাঘের যোগসূত্র। এম এ জি ওসমানীর বাড়ির নাম “সুন্দরবন”, খলিলুর রহমানের বাড়ির নাম “টাইগার ডেল” আর ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হকের বাড়ির নাম “টাইগারস ডেন”।’
আবাসিক বহুতল বাড়ির স্থপতিদের মধ্যে অগ্রগণ্যদের একজন এখন নাহাস খলিল। তাঁর নকশা করা প্রায় প্রতিটি প্রকল্পেই প্রকৃতি আর অন্দর মিশিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকে, যা তিনি নিজের বাড়িতেও বেশ সফলভাবে করেছেন। নাহাস খলিল বলেন, ‘আমাদের শহরে জমি ব্যয়বহুল। প্লটও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বড়লোকদেরও অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে হচ্ছে। সবুজের মধ্যে থাকতে না পারাটা দুঃখবোধ তৈরি করে। তাই ঢাকায় সবুজ আনার চেষ্টা করতে হয় সব সময়। বড় বড় জানালা, খোলা আকাশ দেখার সুযোগ রাখা—বসবাসের জন্য এসবের বেশ প্রয়োজন রয়েছে।’