সিলেট সীমান্তের ঠিক ওপারেই ভারতের আসাম। একসময় একই ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছে এই দুই জনপদের মানুষ। আলাদা হয়ে যাওয়ার পরও আসাম অঞ্চলের কিছু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজও সযত্নে বহন করে চলেছে সিলেট অঞ্চলের লোকজন। তেমনই একটি ঐতিহ্য ‘আসাম বাড়ি’।
১৮২৬ সালে ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধে জয়লাভের পর আসামে প্রশাসনিক অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয় ইংরেজরা। মোগলদের উদ্ভাবিত প্রাসাদ স্থাপত্যের বিপরীতে আসামের প্রকৃতি, পরিবেশ ও আবহাওয়া উপযোগী নতুন একটি স্থাপত্যধারা তৈরি করে তারা। এই স্থাপত্যই পরে ‘আসাম ঘরানার বাড়ি’র পরিচিতি পায়। ‘আসাম বাড়ি’র উৎপত্তি বিষয়ে এমনটাই বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী স্থপতি আনোয়ার ইকবাল। শামছুল মজিদ চৌধুরীর আসাম টাইপ ইউনিক হেরিটেজ হাউজেস ইন সিলেট (জানুয়ারি ২০২২) শীর্ষক বইয়ে ‘আসাম বাড়ি’ শিরোনামে তাঁর একটি লেখা আছে।
১৮৯৭ সালে সিলেটসহ আসাম অঞ্চলে সংঘটিত ভয়াবহ ভূমিকম্পে অনেক প্রাসাদ বিধ্বস্ত হলেও আসাম-আদলের বাড়িগুলো খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এর পর থেকে সিলেট অঞ্চলে এই স্থাপত্যধারার বাড়ি নির্মাণ বাড়তে থাকে। গবেষকদের মতে, ১৯২০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে সিলেট অঞ্চলে আসাম-আদলে বাড়ি সবচেয়ে বেশি নির্মিত হয়েছে। আধুনিক বহুতল ভবনের বিপরীতে এখনো সিলেট অঞ্চলের অনেক মানুষ এমন ধারার ঘর নির্মাণ করে থাকেন।
বাংলোজাতীয় এসব বাড়ি নির্মাণে একসময় বাঁশ, কাঠ, নলখাগড়া, মাটি ও চুন ব্যবহার করা হতো। বাঁশ কিংবা কাঠের ব্যাটন ব্যবহার করা হতো বলে এসব বাড়ি ‘বাংলা ব্যাটন স্টাইল’ নামেও পরিচিতি অর্জন করে। কালক্রমে আসাম বাড়ি নির্মাণে টিন, ত্রিকোণ লোহার বার আর চুন-সুরকি ব্যবহৃত হতে থাকে। এরপর শুরু হয় ইট, পাথর, বালু ও সিমেন্টের ব্যবহার। আসাম-আদলে ধীরে ধীরে দোতলা বাড়িও নির্মিত হতে থাকে। সৌন্দর্য বাড়াতে একসময় অনেকে এসব বাড়ির ছাদের ঢালু প্রান্তসীমায় ধাতব পাত কেটে নকশাদার ঝালরও দিতে শুরু করেন।
আসাম টাইপ ইউনিক হেরিটেজ হাউজেস ইন সিলেট বইয়ে শামছুল মজিদ চৌধুরী জানিয়েছেন, এসব বাড়ি অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব ও আরামপ্রদ। ভেতরের পরিবেশ শীতকালে উষ্ণ ও গ্রীষ্মকালে শীতল থাকে। বায়ুরন্ধ্র (ভেন্টিলেশন) থাকার কারণে এসব বাড়িতে অবাধে বায়ু চলাচলের সুযোগ থাকে। ফলে কখনো দেয়াল ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে হয় না। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ি বিধ্বস্ত হলেও ক্ষয়ক্ষতি হয় তুলনামূলকভাবে কম, বিশেষ করে মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা অনেক কম থাকে।
আসাম-আদলে নির্মিত বাড়ি এই অঞ্চলে এসে কিছুটা পরিবর্তিতও হয়েছে বলে জানালেন স্থপতি আনোয়ার ইকবাল, ‘আসাম বাড়ির নকশায় পুরোনো কিছু রীতিও ধরে রাখা হলো। রান্নাঘর থেকে কোনো কারণে আগুন ছড়িয়ে গেলে তা যেন সহজে শোবার ঘরে পৌঁছাতে না পারে, এ জন্য এই এলাকার বাসিন্দারা দুটোর মাঝখানে একটি খোলা বারান্দা রাখত। প্রয়োজনীয় বিবেচনা করে এটা রেখে দেওয়া হলো। আসামে একটা চৌকো উঠানকে ঘিরে বাড়ি বানানো হতো। বাড়িগুলোর মূল প্রবেশদ্বারের মুখ রাখা হতো প্রবেশপথের উল্টো দিকে, উঠানের দিকে মুখ করে। এভাবে বাসিন্দাদের নিরাপত্তা ও প্রাইভেসি—দুটোই বজায় রাখা হতো। উঠানের অন্য পাশে থাকত প্রক্ষালনের ঘর, মাঝখানে বারান্দা দিয়ে আলাদা না করে কখনো কখনো রান্নাঘরের অবস্থান হতো থাকার ঘরের থেকে দূরে, উঠানের অন্য পাশে। ঘরবাড়ির এসব বিন্যাস নতুন পরিকল্পনায় রয়ে গেল।’
একসময় সিলেটের অধিকাংশ সরকারি কার্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আসাম-আদলে নির্মিত হতো। এসব স্থাপনার অনেকগুলো এখনো সগৌরব টিকে আছে। এ ছাড়া প্রায় বনেদি পরিবারেই আসাম-আদলে আধপাকা বাড়ি প্রচুর নির্মিত হয়েছে। সিলেট শহরের কাষ্টঘর, হাওয়াপাড়া, চালিবন্দর, তাঁতীপাড়া, শাহি ঈদগাহ, আম্বরখানা, বিমানবন্দর সড়ক, দরগাগেটসহ বিভিন্ন এলাকায় এখনো অনেক আসাম বাড়ি দেখা যায়। বৃহত্তর সিলেটের চার জেলার বিভিন্ন গ্রামেও এমন বাড়ির সন্ধান মেলে।
সিলেটের গোলাপগঞ্জের রনকেলি নুয়াপাড়া গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, ১৯৩০ সালে তাঁর দাদা প্রায় ৮ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর আসাম-আদলে বাড়ি বানিয়েছিলেন। টিলার ওপরের ওই বাড়ির সামনে উঠান, আসাম-আদলে একটা বৈঠকখানাও রয়েছে। তিন পুরুষ ধরে বাড়িটিতে বসবাস করছেন তাঁরা, এর মধ্যে কেবল কয়েক দফা সংস্কার করতে হয়েছে। পুরোনো এই বাড়ি দেখতে এখন অনেকেই ভিড় করেন।
আসাম বাড়ির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক কৌশিক সাহা বললেন, বাড়িগুলো বৃহত্তর সিলেট ও আসামের নিজস্ব স্থাপত্যরীতি। সিলেট ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা, তাই এসব বাড়ি এখানে একসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মূলত বাংলা ও আসাম অঞ্চলের লোকজ স্থাপত্যের সঙ্গে ব্রিটিশদের কিছু কারিগরি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছিল।
ভূমিকম্প সহনশীল কাঠামো ও সহজলভ্য উপাদান ব্যবহার করে তৈরি আসাম-আদলে বাড়িগুলো অনেক টেকসই ও পরিবেশবান্ধব। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে সিলেটের এই বিশেষ ঐতিহ্য আজ হুমকির মুখে। কৌশিক সাহার আশঙ্কা, দ্রুত সংরক্ষণের ব্যবস্থা না নিলে এখনো যেসব বাড়ি টিকে আছে, সেগুলোও বিলীন হয়ে যাবে। সিলেটি ঐতিহ্যের বিশেষ এই স্থাপত্যরীতি টিকিয়ে রাখতে এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের উত্সাহিত করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
লেখাটি বর্ণিল বসত মে ২০২৪–এ প্রকাশিত