ফুল, পাতার নকশা করা কাঠের জানালা এখন কমে গেছে, তার জায়গা নিয়েছে কাচ আর থাই। এই সময় বসে জানালার ইতিহাস ঘাঁটলেন অধ্যাপক সাজিদ বিন দোজা
মৌসুমি জলবায়ুর কারণে এই অঞ্চলের বসতে জানালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবহাওয়ার সঙ্গে সংগতি রেখে ভবন নির্মাণ এমনিতেই একটা বৈজ্ঞানিক যজ্ঞ। সিস্টেমটি তখনই কার্যকর হয়, যখন বসতে জানালার ব্যবহার হয় ঠিক ঠিক। পুরো বসতের নিশ্বাস–প্রশ্বাসে সাহায্য করে জানালা। এটি বাতাস ও আলো প্রবেশের প্রধান মাধ্যম। বাতাসের প্রবাহ সব কটা ঘরকে রাখে ঝকঝকে, দূর করে স্যাঁতসেঁতে ভাব।
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে ভিন্ন ভিন্ন বসত নির্মাণের শৈলী দেখা যায়। তার সঙ্গে ঘটেছে জানালারও রূপান্তর। প্রাচীনকালে যাকে আমরা চৈতা বলতাম, সেটাও আসলে জানালা, আরও নির্দিষ্ট করে বললে পুবের জানালা। সেই জানালা গলে ঘরে প্রথম প্রবেশ করত পুবের আলো, তৈরি হতো নাটকীয় আবহ। বৌদ্ধবিহার থেকে শুরু করে সুলতানি আমলের টেরাকোটার মসজিদে ছোট জানালা, মোগল স্থাপনার জালি জানালা, ব্রিটিশ আমলের খড়খড়ি জানালা—এসবই আমাদের মনে করিয়ে দেয় জানালার সমৃদ্ধ ইতিহাস।
ব্রিটিশ–পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে শহরের বসতগুলোয় জানালার বহুমুখী ব্যবহার ছিল। বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ে সম্পূর্ণ হতো একটি জানালা।
খড়খড়ি: পুরো জানালার বাহ্যিক অংশ। শক্তিশালী চিকন কাঠের সঙ্গে উলম্ব চিকন কাঠ সংযুক্ত করে তৈরি হতো খড়খড়ি। কবজার মাধ্যমে খোলা ও বন্ধ করা যেত। এ–জাতীয় জানালা আমাদের এই উপমহাদেশীয় অবহাওয়ায় ঘরের পরিবেশ অনুকূল রাখার মোক্ষম উপায়। এই খড়খড়ির মাধ্যমে সহজেই আলোর আসা–যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা যেত। আবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে একান্ত স্থান তৈরি করতেও সাহায্য করত।
এই জানালার সম্মুখভাগে তিনটি অংশ দেখা যায়। উপরিভাগে কাচ দেওয়া হাই উইন্ডো, মাঝখানে পাল্লাসহ খড়খড়ি আর নিচে পাল্লাসহ খড়খড়ি। প্রতিটি অংশের আলাদা ব্যবহার আছে। হাই উইন্ডোর অংশ বেশি উচ্চতায় থাকায় আলোর প্রবেশ নিশ্চিত হতো। এই অংশের কাচগুলো কখনো কখনো রঙিন হতো। ওই রঙিন কাচ দিয়ে আলো ঢুকে লাল, সবুজ, নীল, হলুদ ছটা হয়ে ঘরের অন্দরে বর্ণিল পরিবেশের সৃষ্টি করত।
দ্বিতীয় অংশের পাল্লা চাইলে খোলাও রাখা যেত। বন্ধ থাকলে খড়খড়ি, উন্মুক্ত করলে আলো–বাতাস দুটোই গোপনীয়তাসহ উপভোগ করা যেত।
তৃতীয় অংশে একদম নিচের জানালাগুলো খোলা রাখলে গরম বাতাস নিচু এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে ক্রমেই ঠান্ডা হয়ে আড়াআড়ি প্রবাহিত হতো।
চাইলে সব কটি পাল্লা উন্মুক্ত করা যায়, আবার ইচ্ছেমতো বা আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিয়ন্ত্রণও করা যায়। পুরোনো শহরে কিছু কিছু পুরোনো বাড়িতে এ ধরনের জানালার উপস্থিতি আজও দেখা যায়।
সেই সময়কার এসব জানালাকে একপ্রকার সম্পূর্ণ সিস্টেম বলা যায়। বাংলার পানিবাহিত বাতাস, প্রখর রোদ, শরতের নীল আকাশ দেখার জন্য উপযুক্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান। নিরাপত্তার জন্য ওই সব জানালার ভেতর দিকে শিক ব্যবহার করা হতো। জানালাগুলো ৮ থেকে ১০ ফুটের একেকটি প্যানেল। এমন জানালার পাশে পড়ালেখার টেবিল বসানো হতো। আবার কখনো অলংকৃত দুটি চেয়ার দুই ধারে রেখে ঘরের ওই অংশ সাজানো হতো। এমনটা করা হতো যাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বা বসে প্রকৃতির মেজাজ উপভোগ করা যায়। অধুনা বাড়ির এককোণে কফি কর্নার বানিয়ে অনেকে যেটা করেন।
পেছন ফিরে দেখি
দুই দশক আগেও এই বঙ্গদেশের বসতভিটায় জানালার বিশেষ তাৎপর্য ছিল। প্রতিদিনের দুনিয়া দেখার একটা ফ্রেম, সামাজিকতার সোপান।
জানালার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল উঠান (গ্রামবাংলায় এখনো হয়তো অল্পবিস্তর টিকে আছে)। এই জানালার পাশে বসেই গৃহকর্ত্রী একসময় তাঁর একান্নবর্তী সংসার পরিচালনা করতেন, প্রতিবেশীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার মূল স্থানই ছিল জানালা। ফরমাশ, আলাপ–আলোচনা, শিশুদের কিচিরমিচির—সব এই জানালা থেকে দৃষ্টিগোচর হতো। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী সবাই জানালার পাশে বসে বাড়ির কাজ সম্পাদন করার সংস্কৃতি বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারের চেনা রূপ ছিল। চেয়ারে বা খাটে বসে জানালা দিয়ে আসা শীতের মিঠে রোদ ছিল আমাদের সবার পছন্দ। পুবের একটু তির্যক আলোকরশ্মি ঘরকে অন্য আলোয় উদ্ভাসিত করত। শুদ্ধতার গন্ধমাখা মায়াবী আলোয় ভরিয়ে দিত ঘর। বর্ষায় জানালার পাশে বসে আনমনে কেটে যেত সারাটি দিন। কার্নিশ বেয়ে পড়া বারিপাতে অবিরাম সিক্ত হতো কাঠের ফ্রেম। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে প্রিয়জনের অপেক্ষায় বয়ে গেছে কত–না সময়। কেউ ফিরেছে, কেউ ফেরেনি। এই জানালাকে কেন্দ্র করে শিল্প-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের লেখক, সাহিত্যিক, কবি, প্রবন্ধকার। পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা ‘উঁকি’ ছবির গুরুত্বপূর্ণ জায়গাজুড়ে আছে জানালা। এই জানালা দিয়েই কাবুলিওয়ালাকে দেখত রবীন্দ্রনাথের খুকি, এই জানালাই ছিল বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে ডাকঘর–এর অমলের যোগসূত্র। এই জানালা দিয়েই হয়তো বনলতা সেনকে দেখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। আবার বুদ্ধদেব বসু এমনই এক জানালায় অল্প সময়ের জন্য দেখেছিলেন একখানা সাদা হাত।
জানালার সেই আবহ থেকে আজ আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি। অনুভূতিগুলো আজ মলিন। বহুতল ভবনে জানালাবিলাসে আজ আমরা বড়ই কৃপণ। আজকালকার বসতবাসীদের যেন আর সময় নেই, নিজেকে একটু সময় দেওয়ার সেই আকর্ষণও নেই। জানালার সেই গল্প অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের চার ফুট বাই চার ফুট পরিসরে আজ বন্দী। টিন্ট কালারের কাচের জানালা দিয়ে আজকাল সামাজিকতা আর হয় না। প্রতিবেশী তরুণ–তরুণীরা জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আহ্লাদ আর প্রেমে মাতে না। চোখে চোখে কথাও বলে না।
জানালার চোখ আজ বদ্ধ। কারণ, জানালার পাশেই অন্য একটা বিদঘুটে ভবনের স্যাঁতসেঁতে দেয়াল। পুবের জানালাটার ওই পাশে হয়তো অস্বাভাবিক কোনো উন্নয়ন। আজকের এই উন্নত নগরজীবনের বাক্সবসতে সূর্যের আলো আর আসে না। জানালা আজ বিষণ্ন। বিপন্ন বসতিরা আজ আত্মকেন্দ্রিক।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, স্থাপত্য বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ