নকশার বৈচিত্র্যে অন্দরসাজ

অন্দরসজ্জার নান্দনিক ও আধুনিক সমাধান দেখাচ্ছেন কাওসার চৌধুরী। ছবি: অধুনা
অন্দরসজ্জার নান্দনিক ও আধুনিক সমাধান দেখাচ্ছেন কাওসার চৌধুরী। ছবি: অধুনা

ঢাকার প্রগতি সরণির ৪৬ নম্বর দালানটির সামনে দাঁড়ালে দেখবেন, দেয়ালে বিশাল করে লেখা আছে ‘কে সি’। সঙ্গে একজনের ছবি। ‘কে সি’ মানে কাওসার চৌধুরী। কাচের দেয়ালে সাঁটানো ওই ছবিটি তাঁরই। ‘গ্রিন ফার্নিচার’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ও শিল্পনির্দেশক তিনি। সাধারণত যা হয়, আসবাবের দোকানে পণ্য অর্থাৎ খাট–পালঙ্কের ছবিই দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নকশাকারই এখানে মুখ্য। তার ওপর গ্রিন ফার্নিচার নয়, শোরুমের নামও রাখা হয়েছে নকশাকারের নামে। ফলে বিষয়টি মনে কৌতূহল জাগায়।

দালানটির দোতলা ও তিনতলায় গ্রিন ফার্নিচারের শোরুম। দোতলায় গিয়ে বসি আমরা। সোফার কুশন টেনে আরাম করে বসার আগেই ওর নকশা নজর কাড়ে। জগদ্বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের ‘নুন–রেস্ট ফ্রম ওয়ার্ক’ ছবিটি শোভা পাচ্ছে ওতে। ভ্যান গঘের ছবিতে সোনালি–ঝাঁজালো দুপুর, খড়ের গাদায় চোখের ওপর টুপি নামিয়ে বিশ্রামরত কৃষক, পাশে সঙ্গিনী। সব দেখে কে সি–বিষয়ক কৌতূহল বেড়েই চলে।

খানিক বাদেই কাচের দরজার ওপাশে একজনকে দেখা গেল। বুঝতে অসুবিধা হলো না, তিনিই কে সি। তিনতলায় হাতের জিনিসপত্র রেখে নিচে নেমে এলেন। কথা শুরু হলো। কাওসার চৌধুরীর কাজ দেখার আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলি আমরা। টিভির পর্দায় প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞাপন দেখি। তারপর দোতলাটা ঘুরে দেখার পালা। তৃতীয় তলায় সবকিছু নতুন করে সাজানো হচ্ছে।

অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি

নতুন করে সাজানো হচ্ছে মানে শোরুমটি পুরোনো। কত পুরোনো? কাওসার চৌধুরী জানান, বাথরুম ফিটিংস ও টাইলসের ব্যবসাটি পৈতৃক। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ঢাকায় শুরু হয়েছিল গ্রিন এজেন্সির যাত্রা। সে সূত্রেই প্রগতি সরণির এ শোরুমে গ্রিন ফার্নিচারের শুরু ২০০৬ সালে। গ্রিন ফার্নিচার এত দিন দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে অন্দরসজ্জার কাজ করে এসেছে। করপোরেট ভাষায় যাকে বলে ‘বিটুবি—বিজনেস টু বিজনেস’ সেবা। তবে এখন গ্রিন ফার্নিচার অন্দরমহল সাজানোর কাজ করছে সাধারণের জন্য, পুরোপুরি নিজেদের নকশায়। কেবল নকশা নয়, পণ্য উৎপাদনের প্রায় সব কাজই চলছে নিজেদের কারখানায়। এ কারণেই ছয় মাস ধরে গ্রিন ফার্নিচারের বর্তমান কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে কে সি নামে। যাঁর মালিক তো বটেই, এক অর্থে শুভেচ্ছাদূতের ভূমিকাও পালন করছেন কাওসার চৌধুরী। কে সি তাঁর চিন্তার প্রতিফলন।

দেশে তৈরি উপকরণ দিয়ে সাজানো েকসির একটি রান্নাঘর

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। কাওসার চৌধুরী দোতলার একদম শেষ প্রান্তে নিয়ে গেলেন আমাদের। একটি ওয়াল প্যানেলের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘ছুঁয়ে দেখুন।’ তথাস্তু। ওয়াল প্যানেলটির রং গাঢ় সবুজ, নকশা বিচিত্র ধরনের। আলো–আঁধারিতে বেশ রহস্যময় হয়ে উঠেছে ওই অংশটুকু। ওয়াল প্যানেলটি ছুঁয়ে দিতেই মনে হলো, আরে, এ তো সাক্ষাৎ কুমিরের পিঠ! কাওসার চৌধুরী জানালেন এর পেছনের গল্প।

ফ্রান্সে একবার একটি ভ্যানিটি ব্যাগের নকশা দেখে খুব মনে ধরেছিল। কুমিরের চামড়া দিয়ে তৈরি ওই ব্যাগের নকশায় একটি ওয়াল প্যানেল তৈরির ভাবনা এসেছে সেখান থেকেই। কেবল নকশা করেই ক্ষান্ত হননি কাওসার চৌধুরী, প্যানেলটি ত্রিমাত্রিকও (থ্রিডি) করে তুলেছেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা করেছেন। প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অর্জনের পর বিদেশ থেকে আমদানি করেছেন প্রয়োজনীয় কাঁচামাল। তারপর কাঁচপুরে নিজেদের কারখানায় সম্পন্ন হয়েছে চূড়ান্ত কাজটুকু। এ রকম আরও কিছু পরীক্ষামূলক ওয়াল প্যানেল দেখালেন কাওসার চৌধুরী। কোনোটির নকশা এসেছে প্রকৃতি থেকে, কোনোটি ভিনদেশের বিখ্যাত হোটেলের দেয়াল থেকে, কোনোটি আবার একেবারেই নকশাকারের নিজস্ব ভাবনা। আগেই জেনেছেন, এসবের নকশাকার কাওসার চৌধুরী নিজে; আরও কজন নকশাকারও কাজ করছেন তাঁর অধীনে। কাজ করছেন একদল প্রকৌশলী। তাঁরা সবাই মিলেই নকশা ও উৎপাদন করছেন ঘরের সিলিং, কিচেন ক্যাবিনেট, দরজা, সোফা, ক্লজেট, মেঝেসহ বাহারি সব আসবাব। সব মিলিয়ে কে সিতে এখন কাজ করছেন ২০০ কর্মী।

মেড ইন বাংলাদেশ

দোতলায় তিন ধরনের কিচেন ক্যাবিনেট সাজানো আছে। চিরকালীন আভিজাত্যের সাজসজ্জা নিয়ে ‘ক্ল্যাসিক’, হাল আমলের নকশা ও উপকরণে সাজানো ঝাঁ–চকচকে ‘মডার্ন’ এবং অত্যাধুনিক নকশা ও প্রযুক্তির ‘ডাবল লাক্সারি’—এই হলো তিন প্রকার। ডাবল লাক্সারির কথাই ধরা যাক। কাওসার চৌধুরীর ভাষায়, ‘এগুলো তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে স্যান্ডউইচ ইউনিট। মানে হলো, উভয় দিকের আবরণ হিসেবে অ্যাক্রিলিক ব্যবহার করা হয়েছে। চকচকে ফিনিশিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ ল্যামিনেশন। ফ্রেমগুলো অ্যালুমিনিয়ামের। এর ধারণা আমি পেয়েছিলাম ইতালীয় কিচেন থেকে। একেবারে খাঁটি ইতালীয় কিচেনের রূপ দিতে তিন মাসের মতো শুধু গবেষণাই করেছি। সবশেষে বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী করে তুলতে হয়েছে। সঙ্গে খেয়াল রেখেছি, পণ্যগুলো যেন পানি ও ময়লারোধী হয়।’

ফরমাশমতো আসবাব তৈরি ও সরবরাহ করা হয়

ক্ল্যাসিক ও আধুনিক ধাঁচের কিচেন ক্যাবিনেটগুলোর বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে ‘গ্রিন’ আছে, তাই কাজের বেলায়ও সবুজপ্রেমী হওয়া জরুরি বলে মানেন কাওসার চৌধুরী। তাই পণ্যগুলোর কাঁচামাল ব্যবহারে অধিকাংশ সময় কাঠের চেয়ে বিকল্প উপাদানেই তাঁর আগ্রহ বেশি। আর নকশার বেলায় ইতালীয় ও মার্কিন ধাঁচই বেশি পছন্দ কাওসার চৌধুরীর। সাত বছর মার্কিন মুলুকে ছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে দেশে ফিরে আসার আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে সম্পন্ন করেছেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পড়াশোনা শেষে যুক্তরাষ্ট্রে কিছুদিন কাজ করেছেন একটি দরজা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে। পৈতৃক ব্যবসা ও হাতে–কলমে কাঠ নিয়ে কাজ করার সে অভিজ্ঞতাই কাওসার চৌধুরীকে করেছে ঋদ্ধ। দেশে ফিরে মার্বেলের ব্যবসায় সফল হয়েছেন। তারপর শুরু করেন গ্রিন ফার্নিচার। আর এখনকার ধ্যানজ্ঞান কে সি।

সম্ভাবনার স্বপ্ন

কাওসার চৌধুরী বলছিলেন, ‘অনেক দিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানের জন্য অন্দরসজ্জার কাজ করছি। তাই বন্ধু–স্বজনেরা সাধারণের জন্যও কিছু করার তাগিদ দিচ্ছিল। সে চিন্তা থেকেই কে সির পথচলা শুরু। আমি নিজেকে পণ্যের নকশাকার ও নির্মাতা হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শিল্পকলা, প্রযুক্তি ও কারিগরি দিকের সমন্বয় ঘটাতে চাই। সে ক্ষেত্রে অন্দরসজ্জা আমার জন্য বড় এক কাজের ক্ষেত্র। আমার বিশ্বাস, আমি নতুন কিছু দিতে পারব। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের পণ্যগুলো সব বাংলাদেশেই তৈরি। ফলে তুলনামূলকভাবে দামে সাশ্রয়ী এবং অবশ্যই বিশ্বমানের।’

কাওসার চৌধুরীকে কে সির শুভেচ্ছাদূত বলছিলাম আমরা। এর কারণও নিশ্চয়ই এতক্ষণে পরিষ্কার। ইউরোপ–আমেরিকান ধাঁচের অন্দরসজ্জার অনুরাগী তিনি। এর প্রতিফলন পড়েছে তাঁর কাজে। তবে নিখাদ দেশি নকশায় অন্দরসজ্জার পরিকল্পনাও করছেন তিনি। সেটি বাস্তব হলে বাংলাদেশি অন্দরসজ্জাই হয়তো একদিন ভিনদেশেও অনুকরণীয় হয়ে উঠবে, এমনটাই বিশ্বাস করেন কে সি।