নিউক্লিয়ার পরিবারের পুনর্মূল্যায়িত বাস্তবতায় এক নতুন ধরনের পরিবার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যার মাধ্যমে সেই আগের একান্নবর্তী পরিবারের ধারণাকেই পুনরায় প্রতিষ্ঠা করবে। সেটা হবে আধুনিক আর নগর জীবনের সঙ্গে মানানসই এবং একই সঙ্গে সময়োপযোগী।
নগরের মানুষ ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। নিউক্লিয়ার পরিবারের ধারণাই আমাদের এই বিচ্ছিন্নকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। ফলে দিনের পর দিন এভাবে থাকতে থাকতে তৈরি হচ্ছে একাকিত্বের বোধ। অনুভূত হচ্ছে নিঃসঙ্গতা। অথচ এরও সমাধান আছে। যেখানে একসঙ্গে থাকার সুযোগ রয়েছে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। আবার আত্মীয় নয় অথচ প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমরা একসঙ্গে থাকলেও সখ্য তেমন গড়ে ওঠে না। এই ব্যবধান মুছে ফেলাও সম্ভব। সম্ভব একসঙ্গে থেকে আত্মীয় হয়ে ওঠা। একটা কমিউনিটি গড়ে তোলা।
আর এই সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছে দেশের শীর্ষ সারি রিয়েল স্টেট প্রতিষ্ঠা বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াজ (বিটিআই)। তারা এই নতুন উদ্যোগের নাম দিয়েছে বিটিআই ওয়েলনেস কমিউনিটিজ। ঢাকায় আপাতত তিনটি (উত্তর খান, ইসিবি চত্বর ও মিরপুর ডিওএইএস রোড) আর চট্টগ্রামে একটি (জালালাবাদ, খুলশী) প্রকল্পের কাজ চলছে। এ ছাড়া শিগগিরই আসছে আরও তিনটি (ইস্কাটন, উত্তরার দিয়াবাড়ি ও মাদানি অ্যাভিনিউ ১০০ ফুট রোড)।
বিটিআই ওয়েলনেস কমিউনিটিজ নিয়ে সম্প্রতি কথা হচ্ছিল প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফআর খানের সঙ্গে। তিনি জানালেন বিস্তারিত; বললেন, সব সময়ই তাঁরা ক্রেতাদের সুবিধার বিষয়কে প্রাধান্য দেন। আমরা চেষ্টা করি আমাদের ক্রেতারা যেন সন্তুষ্ট থাকেন এবং তাঁদের জন্য আরও কী করা যায়, সেটাই থাকে ভাবনার কেন্দ্রে। করোনা মহামারির সময় আমরা পুরোপুরি গৃহবন্দী ছিলাম। সে সময় আমরা চিন্তা করি আমাদের ক্রেতাদের এই রকম সংকটে কোন ধরনের বিশেষ সেবা দেওয়া যায়।
করোনা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা থেকে আমরা অবগত হই, এর থেকে মুক্তি পেতে চাইলে আমাদের শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে মানুষের ইমিউন সিস্টেম ভালো থাকতে হবে। তবেই করোনা মোকাবিলা করা যাবে। আর ইমিউন সিস্টেম ভালো রাখার উপায় হচ্ছে কায়িক শ্রম। কিন্তু এখন আমাদের দেশে যে ধরনের আবাসন ব্যবস্থা দেখা যায়, সেখানে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করতে হলে বাইরে যেতে হবে। কিন্তু করোনার মতো মহামারিতে তো মানুষ পুরোপুরি ঘরবন্দী। এ ছাড়া উপায়ও নেই। কারণ, মহামারি থেকে বাঁচতে ঘরেই থাকতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই প্রসঙ্গে রেশ ধরে তিনি আরও বলেন, পাশাপাশি আরও কিছু সংকট দেখা গেল মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। সংকটগুলো তৈরি হলো মানুষ গৃহবন্দী থাকায়। যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, খেলার মাঠ, পার্কসহ সব ধরনের বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরসহ সব বয়সীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন।
বয়সে ছোটরা গ্যাজেটসনির্ভর হয়ে পড়ল আর বৃদ্ধরা অবসাদগ্রস্ত। এই পরিস্থিতিতে বিটিআই চিন্তা করে নতুন ধরনের আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবে। কারণ, আমরা মনে করি, আবাসন ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলতে, যেখানে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ভেতরেই সব সুবিধা থাকবে। বিটিআইয়ের নামকরণ করেছে ওয়েলনেস কমিউনিটিজ। এটা আসলে আধুনিকভাবে একান্নবর্তী পরিবার গড়ে তোলা। সেটা যেমন আত্মীয়-পরিজনদের নিয়ে তেমনি অন্য প্রতিবেশীদের নিয়েও।
তিনি বলেন, আমাদের পরিবারে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন বয়স্করা। কারণ, বাকিরা অফিস, ব্যবসা বা পড়ালেখায় ব্যস্ত। কথা বলার মানুষ খুঁজতেও বয়স্কদের বাইরে যেতে হয়। কিন্তু আপনার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ভেতরেই যদি একটা পার্ক থাকে, তবে বাকি অ্যাপার্টমেন্টের বয়স্করা একসঙ্গে সেখানে সময় কাটাতে পারবেন; অর্থাৎ একটি কমিউনিটি গড়ে তোলা।
আবার একই পরিবারের ভাই, বোন, মামা-খালা বা কাকা-ফুফুরাও চাইলে একই সঙ্গে থাকতে পারছেন। সবাই একই ভবনে আলাদা আলাদা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে পারছেন। আবার ছুটির দিনে বা অবসরে পার্কে বসে একসঙ্গে সময় কাটাতে পারছেন। এতে পারিবারিক বন্ধনও দৃঢ় হবে।
অন্যদিকে আত্মীয়স্বজনসহ বসবাস না করলেও এমন একটি পার্কের সুবাদে প্রতিবেশীর সঙ্গেও যোগযোগ বাড়বে, কুশলাদি বিনিময় হবে, একসঙ্গে চা খাওয়া হবে। আত্মীয় না হলেও আত্মার সম্পর্ক তৈরি হবে। এ ছাড়া এফ আর খান আরও যোগ করেন, পার্কের পাশাপাশি আলাদাভাবে ওয়াকওয়ের ব্যবস্থাও থাকছে। যেখানে হাঁটাহাঁটি বা জগিংয়ের মতো ব্যায়ামগুলো অনায়াসেই করে নেওয়া যাবে। বাচ্চাদের জন্য সাইক্লিং ওয়েও থাকবে। যেখানে তারা নিরাপদে সাইক্লিং করে নিতে পারবে।
এখানে থাকছে একটি আন্তর্জাতিক মানের জিমনেসিয়াম। সঙ্গে ট্রেইনার। সঙ্গে আরো রয়েছে স্টিম ও সনা বাথের ব্যবস্থা। সুতরাং যাঁরা সময়ের অভাবে শরীরচর্চা করতে পারেন না, তাঁরা চাইলে যেকোনো সময়ই তা করতে পারছেন। আবার জিমের জন্য পরিবারের অন্যদের বাড়ির বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনই হচ্ছে না।
এখানেই শেষ নয়, বিটিআইয়ের ওয়েলনেস কমিউনিটিজে আরও থাকছে একটি বড়সড় সুইমিংপুলও। যেখানে বিভিন্ন বয়সীরা দিনের নানা সময়ে আলাদা আলাদাভাবে সাঁতার কাটতে পারবে। কেবল সাঁতার কাটা নয়, বরং পাশাপাশি পুল এরিয়াতে সময় কাটানোর ব্যবস্থাও থাকবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, বাচ্চাদের জন্য আলাদা করে কিডস পুলও থাকছে। আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম ঠিক রাখতে এই সবগুলো বিষয় জরুরি।
শুধু সাঁতার কেটে তো আর বাচ্চাদের সময় কাটবে না। তাদের জন্য থাকছে আলাদা কিডস প্লে কর্নার। ধরা যাক, মা–বাবা সিনেমা দেখছে বা সাঁতার কাটছে, আড্ডা বা পার্টিতে মগ্ন। এ সময় বচ্চাদের সময় কাটতে চায় না। নানা ঝামেলা বাধিয়ে ফেলে। এমন সময় ছোটরা কিডস প্লে কর্নার উপভোগ করতে পারবে। উপরন্তু, আরও থাকছে আলাদাভাবে ইনডোর ও আউটডোর গেমসের ব্যবস্থা।
করোনার সময় যেমন সিনেমা হলগুলো বন্ধ ছিল। অনেককেই আক্ষেপ করতে শোনা গিয়েছে পরিবার নিয়ে অনেক দিন হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয় না। এই আক্ষেপ ঘোচাতে এখানে থাকছে ওপেন এয়ার মুভি থিয়েটার। যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই পরিবার এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে সিনেমা উপভোগ করতে পারবেন।
এই আয়োজনে আরো আছে পারিবারিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য কমিউনিটি হল। যেখানে ভালোভাবেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তিন শর বেশি মানুষের পার্টির আয়োজন করা সম্ভব। বাইরে অনুষ্ঠান হলে নানা ধরনের বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয়। এ ছাড়া কমন রিডিং রুম, মিটিং রুমও থাকছে। হয়তো অফিস থেকে জরুরি মিটিংয়ের জন্য সহকর্মীরা হাজির। বাসার ড্রয়িংরুম মিটিংয়ের জন্য যথাযথ নয়, আবার ফ্যামিলি প্রাইভেসিও নষ্ট হতে পারে। তাই আলাদা মিটিং রুমে কাজ এবং আপ্যায়নের পালা সেরে নেওয়া যাবে।
তিনি বলছিলেন, এখন একটি ট্রেন্ড বেশ চলছে, একটু অবসরেই পরিবার নিয়ে কোনো রেস্টুরেন্টে সময় কাটানো, আড্ডা দেওয়া আর খাওয়াদাওয়া। তবে এখানকার আবাসিকদের সে জন্য বাইরে যাওয়ারও দরকার নেই। বরং তাদের জন্য থাকছে ফ্যামিলি বারবিকিউ জোন।
করোনার ঝুঁকি নিয়ে বাইরে না গিয়ে নিজের আবাসিক ভবনের রুফটপে যে কেউ রেস্টুরেন্টের স্বাদ পেয়ে যেতে পারেন, পরিবারের। ফলে এর চেয়ে বাড়তি পাওয়া আর কী হতে পারে। বিটিআই ওয়েলনেস কমিউনিটিজে এমন সব আয়োজন রাখছে মূল আবাসিক ভবনের ভেতরেই। যাতে হয়তো হাতে গোনা দু–একটি কাজ ছাড়া ভবনের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।
এফ আর খান বলছিলেন, বিটিআই ওয়েলনেস কমিউনিটিজ এমন এক আবাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বিকাশের সঙ্গে পরস্পরের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হবে। সহজভাবে বলা যায়, আধুনিকভাবে যৌথ পরিবারের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
যেখানে একই ভবনের আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটে থাকছে পরিবারের সবাই। এ ধরনের পারিবারিক বন্ধনের সুফল ভোগ করবে সন্তানেরা। তাদের মানসিক বিকাশ সঠিকভাবে হবে। পরিবারের সবার আদর, স্নেহ, ভালোবাসা আর গঠনমূলক শাসনে তাদের বেড়ে ওঠায় পূর্ণতা পাবে, যার অভাব আমরা বোধ করে থাকি। এ জন্য একধরনের মনঃকষ্টেও ভুগি।
বস্তুত ঢাকার অধিকাংশ ফ্ল্যাটবাসী জানেন না তাঁদের পাশের বাসায় কে থাকেন। এর একটাই কারণ, তাঁদের মধ্যে আত্মিক বন্ধন তৈরির কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি ছোট একটি ছাদ থাকলেও সেখানে সবার যাওয়ার অনুমতি থাকে না। আবার অনুমতি থাকলেও উপযুক্ত পরিবেশ থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের অন্যদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা থাকে নাজুক।
বিটিআই এখানেই চায় পরিবর্তন ঘটাতে। গ্রাহকেরা যেন শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মন ও মননেও সুস্থ থাকেন। ওয়েলনেস অনেকেই মনে করেন আবাসন খাতে এ ধরনের সুবিধা পেতে চাইলে শহরের একটু বাইরে যেতে হবে; কিন্তু বিটিআই এবার এ ধরনের প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে ঢাকার ভিতরেই।
ছবি: বিটিআই