যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেডিকেল প্রকৌশল বিভাগে পিএইচডি করছেন বাংলাদেশের মেয়ে রামিসা ফারিহা। সেখানকার ত্রিপাঠী ল্যাব ফর মাইক্রোফ্লুইডিক ডায়াগনস্টিকস অ্যান্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গবেষণা করছেন তিনি। সম্প্রতি রামিসার নেতৃত্বে গবেষকদের একটি দল নারীদের প্রসব–পরবর্তী স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি গবেষণায় সাফল্য পেয়েছে। তাদের গবেষণায় কী কী বিষয় ছিল তানভীর রহমানকে বিস্তারিত জানালেন রামিসা ফারিহা।
যেভাবে গবেষণায় আগ্রহ
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় ডব্লিউডব্লিউই-র কুস্তিগির ডেভ বাতিস্তার ভীষণ ভক্ত ছিলাম। এখন তিনি মার্কিন ছবিতে অভিনয় করেন। মার্ভেলের ‘গার্ডিয়ান অব দ্য গ্যালাক্সি’ সিরিজে ড্র্যাক্স চরিত্রে অনেকে হয়তো তাঁকে দেখেছেন। তিনিই বাতিস্তা আনলিশড নামে একটা বই লিখেছেন। সেখান থেকেই ডিম্বাশয় ক্যানসার সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। খুব অবাক হয়েছিলাম। এটা একটা রোগ এবং এই অঙ্গ আমার নিজেরও আছে, অথচ আমি কিছুই জানি না! এরপর ডিম্বাশয়, ডিম্বাশয় ক্যানসার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করি। তখন ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জেফ মর্গানের একটা কাজ দেখি। তিনি ইঁদুরের কৃত্রিম ডিম্বাশয় বানাচ্ছিলেন। ওটা দেখে আমার মনে হয়, পৃথিবীতে এর চেয়ে চমকপ্রদ আর কিছুই হতে পারে না। মূলত তখন থেকেই আমার এ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল।
আগে যেসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছি
কেমোথেরাপি দিলে ক্যানসারের কোষ কীভাবে মারা যায়, সেটা নিয়ে স্নাতকোত্তরে কিছু কাজ করেছিলাম। পিএইচডিতে আসার পর ব্রাউনের অধ্যাপক অনুভব ত্রিপাঠীর অধীন কাজ শুরু করি। রক্তের একটা উপাদান থেকে টেস্টোরয়েড কীভাবে নির্ণয় করতে হয়, সেটা ছিল আমার প্রথম প্রকল্প। তারপর শিশুদের জন্মগত রোগ কনজেনিটাল অ্যাড্রেনাল হাইপারপ্ল্যাসিয়া নিয়ে কাজ করেছি।
রোগ শনাক্তের জন্য একদম ছোট বাচ্চাদের রক্ত নেওয়াটা খুবই বেদনাদায়ক। তাই থুতু থেকে কীভাবে রোগ শনাক্ত করা যায়, সেটা ছিল আমার দ্বিতীয় প্রকল্প। এরপরই বিষণ্নতারোধক ওষুধ নিয়ে কাজ শুরু করি।
সাম্প্রতিক গবেষণা
প্রসব–পরবর্তী সময়ে নারীরা এক ধরনের বিষণ্নতায় ভোগেন, যাকে বলে ‘বেবি ব্লুজ’। আবার নতুন মায়েদের মধ্যে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, অনিশ্চয়তা কাজ করে। যেমন তাঁরা ভালো মা হতে পারছেন কি না, ভালোভাবে বাচ্চার পরিচর্যা করতে পারছেন কি না। এ সময় অনেকেই অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিষণ্নতারোধী ওষুধ খেয়ে ফেলেন। পেট ব্যথা বা অনিদ্রার কারণেও অনেকে না বুঝে এই ওষুধ খেতে থাকেন। বাংলাদেশে এসব ওষুধ পাওয়াও খুব সহজ। এসব ওষুধের অনেক রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যেমন ওজন বেড়ে বা কমে যাওয়া, মাথা ব্যথা, বমি। আমরা এমন একটি কিট তৈরি করেছি, যা দিয়ে খুব সহজেই রোগীর শরীরে বিষণ্নতারোধী ওষুধের মাত্রা পরিমাপ করা যাবে।
গবেষণার পাশাপাশি
প্রজননস্বাস্থ্য–বিষয়ক সচেতনতা তৈরির কাজেও আমার বিশেষ আগ্রহ আছে। ক্যানসার নিয়ে কাজ করে, এ রকম অনেকগুলো মার্কিন সংগঠনের সঙ্গে আমি যুক্ত আছি। তাদের তহবিল গঠনমূলক নানা রকম আয়োজনে আমি থাকি। এই মাসে যেমন ওভারিয়ান ক্যানসার রিসার্চ অ্যালায়েন্সের তহবিল গঠনের জন্য ৬০ মাইল হাঁটব। বাংলাদেশেও আমি এ ধরনের কাজ করতে চাই। ডিম্বাশয়ের ক্যানসার কীভাবে দ্রুত শনাক্ত করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করার প্রবল আগ্রহও আমার আছে।
২০১৮ সালে এই অসুখেই আমার এক ফুপিকে হারিয়েছি। এই ক্যানসারের একটা বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এটা প্রাথমিক পর্যায়ে কেউ ধরতে পারে না। যখন ধরা পড়ে, তখন বাঁচার আর উপায় থাকে না।
প্রিয় বাংলাদেশ
আমার জন্ম নারায়ণগঞ্জে। জীবনের অর্ধেক সেখানে কাটিয়েছি, বাকি অর্ধেক এখানে (যুক্তরাষ্ট্রে)। কিন্তু দেশকে ভীষণ মিস করি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ বাড়ি গিয়েছিলাম। তারপর আর দেশে যাওয়া হয়নি। স্নাতক-স্নাতকোত্তরে আমি বিভিন্ন উচ্চতর প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করেছি। তখন মা প্রায়ই বলতেন, ‘তুমি যেসব কাজ করো, সেগুলো তো ধনীদের জন্য। বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করবে কবে?’ অবশেষে এই গবেষণাটা করতে পেরে আমি খুশি। এখন ধীরে ধীরে যে পথে এগোচ্ছি, সেটা সবারই কাজে লাগবে। ইচ্ছা আছে বাংলাদেশে একটা প্রতিষ্ঠান করব, যেখানে স্বল্প বা বিনা মূল্যে নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয় করা যাবে।
অনুপ্রেরণা
বাতিস্তার কাছে আমি সব সময় কৃতজ্ঞ। তিনি যদি বইটা না লিখতেন, আমার কখনো এ বিষয়ে আগ্রহ হতো না। আরেকজন আছে। আমার ছোটবেলার রসায়ন শিক্ষক মোমিন স্যার। স্যার আমাকে রসায়নে উদ্বুদ্ধ না করলে আমি হয়তো কোনো দিন গবেষণায় যেতাম না। আমার পরিবারে একেক জন একেক রকম। বাবা উকিল, মা সমাজসেবী, ভাই চিত্রশিল্পী, ভাবি ব্যবসায়ী। সুতরাং আমাদের পরিবারে একটা বৈচিত্র্য আছে। ছোটবেলায় ভাবতাম, বড় হয়ে বাবার মতো উকিল হব।