সময় যায় কিন্তু বাঘ আর যায় না

সুন্দরবনের টহল ফাঁড়িটির নাম চান্দেশ্বর। শরণখোলা রেঞ্জের এই ফাঁড়ির পাশেই একটা মিঠাপানির পুকুর আছে। পুকুরটায় বনের অনেক পশুপাখিই পানি খেতে আসে। ৩ ফেব্রুয়ারি এসেছিল এক জোড়া বেঙ্গল টাইগার। তবে অন্যদের মতো গলা ভিজিয়েই ফিরে যায়নি, টহল ফাঁড়িতেই আতিথেয়তা নিয়েছিল। তারপর কী হলো? ইনজামামুল হককে গা ছমছম সেই অভিজ্ঞতাই শোনালেন ফাঁড়িটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ

চান্দেশ্বর ফাঁড়ির পুকুরে পানি খেতে এসেছে এক জোড়া বেঙ্গল টাইগার

৩ ফেব্রুয়ারি। বেলা দুইটা কি সোয়া দুইটা হবে। দুপুরের খাবার সেরে আমরা কয়েকজন অফিস রুমে যাচ্ছিলাম। পুকুরটার উত্তর পাশে তাকাতেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল—বাঘ! আমরা পুকুরের দক্ষিণ পাশে ছিলাম। বাঘ দেখে পা আর সরে না, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি। তিন মাস ধরে সুন্দরবনের এই ফাঁড়ির দায়িত্বে আছি। অনেক প্রাণীর সঙ্গেই সাক্ষাৎ হয়েছে। কিছুদিন আগে এই পুকুর পাড়েই বাঘের পায়ের ছাপও দেখেছি। তবে দিনদুপুরে সাক্ষাৎ বাঘের দেখা এই প্রথম।

আমরা নট নড়নচড়ন অবস্থায় থাকতে থাকতেই জঙ্গল থেকে আরও একটা বাঘ বেড়িয়ে এল। আগেরটার পাশে পাশে পুকুর পাড়ে ঘোরাফেরা শুরু করল। কখনো আবার দুজনে খুনসুটিতে মেতে ওঠে। হঠাৎই একটি বাঘ পুকুরে নেমে পানি খেতে শুরু করে। দেখাদেখি অন্য বাঘটিও পানি খেতে নামে। পুকুরের অপর পাড়ে অনেকটা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমরা। ভয়ে ভয়ে দুই বাঘের কাণ্ড দেখছি।

পুকুর পাড়ে পায়চারি করছে বাঘ দুটি

পানি খাওয়া শেষ করে বাঘ দুটি আবারও পাড়ে ওঠে আসে। গা ঝাড়া দিয়ে উত্তর পাড়ের নারকেল গাছের পাশ দিয়ে গিয়ে পায়চারি করতে থাকে। ততক্ষণে পার হয়ে গেছে এক ঘণ্টারও বেশি সময়। আমরা ঠাঁয় দাঁড়িয়েই আছি। ফাঁকে মুঠোফোনে কিছু ছবিও তুলি। তারপর বাঘ দুটি সামান্য আড়ালে চলে যায়। মনে হলো জঙ্গলে ফিরে গেল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কিন্তু সামনে এগিয়ে একটু এদিক-ওদিক খুঁজতেই দেখি পুকুর পাড়ের নিচেই একটু আড়ালে বাঘ দুটি বসে আছে। কী সাংঘাতিক! পাড়ের নিচ দিয়ে বাঘ দুটি এলে আমরা দেখতেই পেতাম না। আমরা দ্রুত সরে আসি। এর মাঝেই বাঘ দুটি আবারও ওপরে উঠে আসে। একটা নারকেল গাছের দুই পাশে দুজনে বসে পড়ে। পুকুরের অন্য পাড়ে আমাদের দেখতে থাকে। তাদের থেকে আমাদের দূরত্ব
মোটে ৬০ থেকে ৭০ ফুট। তারা অলস ভঙ্গিতে আমাদের দেখছিল। মাথা, ঘাড় নেড়ে, চোখের পলক ফেলে নানা ভঙ্গি করছিল। আমরাও ফোনে ভিডিও করতে থাকি।

সময় বয়ে যায়, বাঘ আর সরে না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। এত দীর্ঘ সময় তারা এক জায়গায় আছে, বনে ফিরে যাচ্ছে না, খুব দুশ্চিন্তা হয়। কী করা উচিত ভাবতে থাকি। সবার মধ্যেই কিছুটা ভয় ভর করে।

চান্দেশ্বর ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ

পুকুরের পশ্চিম পাড়েই ফাঁড়ির নতুন ভবন। এ ভবনেই চলে অফিসের কার্যক্রম। পুকুরের উত্তর–পশ্চিম পাশে পুরোনো কাঠের ঘরটা  ব্যারাক। নতুন ভবন আর ব্যারাকের মাঝের দূরত্ব ১০০ মিটারের মতো হবে। আসা-যাওয়ার জন্য কাঠের সেতুর মতো আছে। যাকে আমরা বলি ট্রেইল। সেটা ৩০ থেকে ৩৫ ফুট হবে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে আমরা অফিস কক্ষে অবস্থান নিই। জেলেদের জন্য চিন্তা হয়। নদীতে পাশ করা (অনুমতি নেওয়া) জেলেরা থাকেন। অনেক সময় তাঁরা রাতের বেলা নদী পাড়ের কাছাকাছি অবস্থান করেন। তখন বাঘ দুটি যদি আক্রমণ করে বসে। সহকর্মীদের বলি, দুপুর থেকে নিয়মিত টহলে যাওয়া হচ্ছে না। একটু নদীপথটা ঘুরে আসো। জেলেদেরও সতর্ক করে দেওয়ার জন্য বলি।

আলো থাকতে থাকতেই কয়েকজন নিয়মিত টহলে বেরিয়ে যান।

রাত আটটা কি সোয়া আটটার দিকে টহল শেষ করে সহকর্মীরা ফিরে আসেন। জেটিতে নৌকা বেঁধে কয়েক ফুট সামনের পুরোনো অফিসে
কক্ষে ঢোকেন। সন্ধ্যা থেকেই আমি পাশের নতুন অফিস ভবনে ছিলাম। দুপুরেই ভাত রান্না করা ছিল। তাঁরা চার থেকে পাঁচজন মিলে পুরোনো ভবন থেকে খাবার রেডি করে আমার জন্য নিয়ে আসছিল।

ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁরা যখন ট্রেইলের মাঝামাঝি, নিচে তাকিয়ে দেখে বাঘ দুটি শুয়ে আছে। রাতের অন্ধকারে টর্চের আলোয় বাঘ দেখে তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়। ওদের দিকে কিছুটা আক্রমণাত্মকভাবে তাকায় বাঘ। ভয়ংকর একটা মুহূর্ত। ওরা আর সামনে এগোয় না, ধীরে ধীরে পুরোনো ভবনে ফিরে যায়। রুমের দরজা আটকে ফোন দিয়ে আমাকে ঘটনা জানায়। তাঁদের আমি রুমেই থাকতে বলি।

বিষয়টি আমি আমার এসিএফকে (সহকারী বন সংরক্ষক) জানাই। তিনি আমাদের সতর্ক থাকতে বলেন। পরামর্শ দেন কিছু দিয়ে শব্দ করলে বাঘ চলে যেতে পারে। তাঁর কথা মতো দীর্ঘক্ষণ আমরা চেষ্টাও করি। কিন্তু বাঘ আর সরে না। উল্টো বাঘগুলো কিছুক্ষণ পর ফাঁড়ির রান্নাঘরের পাশে এসে বসে নির্বিকারভাবে আয়েশ করতে থাকে। রাত গভীর হয়। ঘরের পাশে বাঘ বসে আছে, ঘুম কি আর আসে। সারা রাত নির্ঘুম কেটে যায়। পরে জানতে পারি, গভীর রাতে জানালা দিয়ে টর্চের আলোয় বনকর্মীরা আগের দুটির সঙ্গে আরও একটি বাঘ দেখতে পান।

নির্ঘুম রাত শেষে ভোর হয়। তখনও ফাঁড়ির আশপাশেই বাঘ বসে আছে। আমরা ঘরে অনেকটা অবরুদ্ধ। বেরই হতে পারছি না। প্রায় সকাল ১০টা পর্যন্ত বাঘগুলো ফাঁড়ির আশপাশেই ছিল। এভাবে এত দীর্ঘ সময় বাঘ জনসমক্ষে থাকে, কখনো শুনিনি। অনেকক্ষণ সাড়া শব্দ না পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে বুঝতে পারি কোনো এক ফাঁকে ফাঁড়ি ছেড়ে বনে ফিরে গেছে তারা।