ম্যারাথনে কোনো পদক পাওয়া তো দূরের কথা, ভুটানের এই খেলোয়াড় হয়েছেন সর্বশেষ প্রতিযোগী
ম্যারাথনে কোনো পদক পাওয়া তো দূরের কথা, ভুটানের এই খেলোয়াড় হয়েছেন সর্বশেষ প্রতিযোগী

অলিম্পিক ম্যারাথনে শেষ প্রতিযোগী তিনি, এরপরও কেন চ্যাম্পিয়ন বলা হচ্ছে?

প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভুটানের পতাকা বহন করেন ২৬ বছর বয়সী কিনজাং লামো। প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ভুটানের তিন ক্রীড়াবিদের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী। ভুটানের সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছেন কিনজাং। সেনাবাহিনীতে যোগদানের পরেই তিনি দৌড় শুরু করেন। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে জেতেন ভুটান ম্যারাথনের পদক। এর আগে ২০২২ সালে হিমালয় পর্বতমালার মধ্য দিয়ে ১২৬ মাইলের দৌড়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন লামো। ১১ জুলাই প্যারিস অলিম্পিকের ম্যারাথনে অংশ নেন কিনজাং লামো। সেখানে কোনো পদক পাওয়া তো দূরের কথা, হয়েছেন সর্বশেষ প্রতিযোগী। এরপরও প্যারিস অলিম্পিক তাঁকে দিয়েছে ‘স্ট্যান্ডিং অভেশন (দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন)’। কিন্তু কেন এমন সম্মান পেলেন এই ভুটানি ক্রীড়াবিদ?

ম্যারাথন শেষ করতে ৩ ঘণ্টা ৫২ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড সময় নেন লামো

গরম আবহওয়ার মধ্যে পাহাড়ি পথে ছিল এবারের অলিম্পিক ম্যারাথনের ট্র্যাক। ১১ জুলাই ম্যারাথন সম্পন্ন করা শেষ ক্রীড়াবিদ ছিলেন কিনজাং লামো। যিনি ম্যারাথনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, তাঁর চেয়ে দেড় ঘণ্টা পরে ফিনিশ লাইন স্পর্শ করেন লামো। ম্যারাথন শেষ করতে ৩ ঘণ্টা ৫২ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড সময় নেন লামো। শেষ এক মাইল অতিক্রম করার সময় লামোর গতি কিছুটা ধীর হয়ে পড়ে। কিন্তু এরপরও তিনি দৌড়ে গেছেন। এ সময় দর্শকেরাও তাঁর পাশে সাইকেল চালিয়ে ও দৌড়ে তাঁকে উৎসাহ দিয়েছেন। হাল ছেড়ে না দিয়েও তাই ৮০তম নারী দৌড়বিদ হিসেবে অলিম্পিক ম্যারাথন শেষ করেন লামো। জয়ই শেষ কথা নয়, অংশগ্রহণটাই আসল—অলিম্পিকের এই চেতনার মূর্ত প্রতীক হিসেবে কিনজাংকে দেখছেন সারা বিশ্বের দর্শক। পদক জয়ের আশা ফুরিয়ে যাওয়ার পরও খেলোয়াড়ি মনোভাব শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার জন্যই সবার কাছ থেকে হাততালি আর দাঁড়িয়ে অভিবাদন পেয়েছেন কিনজাং লামো।

নিজের ম্যারাথন সম্পন্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন লামো

ভিডিওতে দেখা যায়, দর্শকেরা কিনজাংকে ‘গো গো’ বলে তালি দিয়ে উৎসাহিত করে যাচ্ছিলেন। অলিম্পিকে যেখানে প্রতি সেকেন্ডরও ন্যানো সেকেন্ডকে পুরস্কার নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়, সেখানে আগের দৌড়বিদ বহু আগে সামনে চলে গেলেও কিনজাং লামো হাল ছেড়ে বেরিয়ে যাননি। তিনি তাঁর ম্যারাথন সম্পন্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কখনো তিনি ধীরে ধীরে হেঁটেছেন, কিন্তু থামেননি। প্রথমে একজন দর্শক তাঁকে উত্সাহিত করতে শুরু করেন। তাঁকে দেখে অন্য অনেক দর্শক উৎসাহ দিতে শুরু করেন। দর্শকদের মধ্যে একজন ভুটানি সমর্থকও ছিলেন। সেই সমর্থক কিনজাংকে উৎসাহ দিতে ভুটানের পতাকা নেড়ে শেষ অবধি তাঁর পাশে প্রায় ১০ কিলোমিটার দৌড়েছেন। যখন কিনজাং দৌড় শেষ করেন, তখন জনতা করতালি ও চিৎকারে করে তাঁর উদ্‌যাপন ভাগ করে নেন। কিনজাংয়ের অটল মনোভাব ও বিজয়ী চেতনার জন্য সবাই দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানান। টিভি ভাষ্যকার তখন মন্তব্য করেন, ‘আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, একজন অলিম্পিক ম্যারাথন রানার এত দীর্ঘ সময় মাঠে থেকেছেন কি না। আমি এমনটাও দেখিনি যে শেষ স্থানে থাকা একজন রানারকে এভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে।’ কিনজাংয়ের ফিনিশিং লাইন অতিক্রম করার সময় মনে হলো যেন সবাই জিতেছেন—মানবতার জয় হয়েছে। শেষ প্রতিযোগী হলেও তাই টিভি ভাষ্যকার লামোকে ম্যারাথনের প্রকৃত চ্যাম্পিয়ন বলে ঘোষণা দেন।

প্যারিস অলিম্পিকে কিনজাং তাঁর সেরা সময়ের চেয়ে বেশ ধীরে দৌড় শেষ করেন। অলিম্পিকের ক্রীড়াবিদ হিসেবে এমন দৃঢ়তা দেখানোর জন্য সারা বিশ্বে এখন আলোচিত হচ্ছেন কিনজাং লামো। প্যারিস ম্যারাথনে এত সময় নিয়ে শেষ করার পরে কিনজাং লামোকে আরেক ম্যারাথন দৌড়বিদ তানজানিয়ার জন স্টিফেন আখওয়ারির সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। স্টিফেন আখওয়ারি ১৯৬৮ সালে অলিম্পিক ম্যারাথনে অংশ নিয়ে মাঝপথে আহত হয়েছিলেন, কিন্তু সেই অবস্থায়ও শেষ করেছিলেন দৌড়। শেষ জেনেও জন কেন দৌড়েছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে স্টিফেন আখওয়ারি বলেছিলেন, ‘আমার দেশ আমাকে দৌড় শুরু করার জন্য ৫ হাজার মাইল দূরে পাঠায়নি। পাঠিয়েছে আমাকে দৌড় শেষ করতে।’

সূত্র: রয়টার্স