আমরা কজন মন্দিরের ফটকে দাঁড়িয়ে গেলাম

মন্দির পাহারায় বানিয়াচংয়ের কয়েকজন তরুণ
ছবি: সংগৃহীত

আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সাবেক ছাত্র। পড়াশোনা শেষ করে এখন চাকরির চেষ্টায় আছি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকাতেই থাকি। কোটা সংস্কার আমারও প্রাণের দাবি, তাই এটা নিয়ে আন্দোলন শুরু হলে আমিও তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। ক্যাম্পাসে ছোট ভাইদের সহায়তা করি। পরে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। হল ছাড়তে বাধ্য হয় শিক্ষার্থীরা। অনেকে গ্রেপ্তার হয়। গণগ্রেপ্তার ও ধরপাকড়ের মধ্যে আমি গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে চলে আসি।

তবে বাড়ি এসেও আন্দোলন বজায় রাখি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানের খবর জেনে দুপুরে আমরা বানিয়াচংয়ের আন্দোলনকারীরাও বিজয়ের আনন্দ নিয়েই ঘরে ফিরে গিয়েছিলাম। এমন পরিস্থিতিতে আসলে ঘরেও বেশিক্ষণ মন টেকে না। তাই সন্ধ্যার পর আবার একে একে উপজেলা সদর হাসপাতালের সামনে জড়ো হই। হাসপাতালের গেটের কাছেই একটা মন্দির আছে। বুড়া শিববাড়ি মন্দির। বানিয়াচংয়ের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাচীনতম উপাসনালয়। তার পাশেই কয়েকটা দোকান ঘিরে আমাদের আড্ডার জায়গা।

সরকারের পতনের পর এখন কী হবে? বানিয়াচংয়ে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের জন্য আমরা কী করতে পারি, এসব নিয়েই আলোচনা। আলাপের ফাঁকে একজনের মোবাইল থেকে ফেসবুকে লগইন করি। এ আন্দোলনে আমার দুটি স্মার্টফোনই বিকল হয়ে গেছে, তাই আর ফেসবুকে ঢোকা হচ্ছিল না।

সেদিন ফেসবুকে ঢুকেই দেখি খালি অস্থিতিশীল পরিবেশ নিয়ে আলোচনা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের খবর, তাদের ঘরবাড়ি আর উপাসনালয়ে হামলা লুটপাটের আলাপ। রাত হতে হতে আমাদের বানিয়াচংয়ের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যেও আতঙ্কের ছাপ লক্ষ করলাম। তখনই মনে হলো, আমাদের এলাকার অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর এমন হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর যদি হয়, যদি জানমালের ক্ষতি হয়, তবে তাদের সামনে এই মুখ নিয়ে কীভাবে দাঁড়াব?

এই তরুণদের দেখে বানিয়াচংয়ের আরও অনেকে মন্দির পাহারায় এগিয়ে আসে

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আমাদের এখানে এসব হতে দেব না। কত কিছু মনে পড়ে গেল। আমি আমার নানাবাড়ি চৌধুরীপাড়ায় বড় হয়েছি। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, বানিয়াচংয়ে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে আমরা সবাই মিলেমিশে আছি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে একে অপরের মুখ দেখে শুরু হয় আমাদের দিন। আমাদের বাড়িতে পারিবারিক, সামাজিক অধিকাংশ অনুষ্ঠানেই হিন্দুধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখতেন নানা, তাতে সাগ্রহে অংশ নিতেন তাঁরা, ধর্মীয় রীতিনীতি মেনেই তাঁদের আপ্যায়িত করা হতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার বন্ধু ছিল বিপ্লব চন্দ শীল, রাজু অধিকারী। একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া, মাঠে ফুটবল খেলে পুকুরে গোসল থেকে শুরু করে সবকিছুতেই আমরা ভ্রাতৃপ্রতিম ছিলাম। কখনো নিজেদের আলাদা করে মনে হয়নি।

তখনই আমরা কজন বুড়া শিববাড়ির ফটকে দাঁড়িয়ে গেলাম। হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম, রক্ত থাকতে কারও ক্ষতি হতে দেব না। ৫ আগস্ট রাতে আমরা মন্দিরের ফটকে দাঁড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বন্ধু-ছোট ভাইদের মাধ্যমে তথ্যটা জানিয়ে দিলাম তাদের পরিবারের কাছে। আশ্বস্ত করলাম, আমরা আছি, কোনো ভয় নেই। ফটকে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছবিও তুললাম আমরা। নিজেদের অবস্থানের কথা জানিয়ে ফেসবুকে পোস্টে দিতেই হু হু করে শেয়ার হতে থাকে। আমাদের দেখে বানিয়াচংয়ের আরও মন্দির পাহারায় এগিয়ে আসে তরুণেরা। এরই মধ্যে আমার পোস্টে বন্ধু বিপ্লব চন্দ শীলের কমেন্ট দেখতে পাই। এখন সে প্রবাসী। দূর দেশ থেকে সে লিখেছে, ‘সত্যিই মনটা আনন্দে ভরে গেল, এই দেশটা আমাদের সবার, তোরা বুঝিয়ে দিয়েছিস।’