বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় যেভাবে ১১ দিন কাটালেন প্রথম আলোর এই সাংবাদিক

২ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। দুই পক্ষের ছোড়া গুলি আর মর্টার শেল বাংলাদেশে এসে পড়তে থাকে। সংবাদ সংগ্রহ করতে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে ছুটে যান প্রথম আলোর চকরিয়া প্রতিনিধি এস এম হানিফ

বাংলাদেশ–মিয়ানমার মৈত্রী সড়কে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে যান চলাচল। সতর্ক পাহারায় রয়েছেন বিজিবি সদস্যরা। ১৩ ফেব্রুয়ারি সকালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায়

৪ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা। ঢাকা অফিস থেকে ফোন। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মিয়ানমার সীমান্তে যেতে হবে। ওপারে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলছে। এপারেও এসে পড়েছে তার আঁচ। দুরুদুরু বুকে ব্যাগপত্র গুছিয়ে দিল স্ত্রী। কিন্তু বিপত্তি বাধাল আমার চার বছরের ছেলে। দূরে কোথাও যাচ্ছি শুনলেই সে ব্যাগ নিয়ে টানাটানি শুরু করে, যেতে বারণ করে। দুদিনের মধ্যেই ফিরে আসব, আর সঙ্গে আনব অনেক খেলনা—এই প্রতিশ্রুতিতে যাওয়ার অনুমতি মিলল।

আমার গন্তব্য নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা। চকরিয়া থেকে কক্সবাজারের গাড়ি ধরলাম। লিংক রোডে নেমে একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে উখিয়ার টিভি টাওয়ারে নামলাম। সেখান থেকে ঘুমধুমের তুমব্রু যাওয়ার গাড়ি আর পাই না। যুদ্ধের মধ্যে কেউ আর সেদিকে যেতে রাজি নয়। কিছুটা হেঁটে একটা অটোরিকশা পেলাম। চালক বললেন, তুমব্রুর দিকে প্রচুর গোলাগুলি ও বোমা পড়ছে। যতটুকু যেতে পারি ততটুকুর জন্য ১৫০ টাকা দিতে হবে।

তাই, সই!

সীমান্তের ওপার থেকে আসা একটি গুলি দেখাচ্ছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি

একজনের পায়ে গুলি লাগল

বিকেল চারটা নাগাদ ঘুমধুমের পশ্চিমকূল-তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছাই। বিদ্যালয়টি পাহাড়ের ওপর হওয়ায় ওপারের পরিস্থিতি দেখা যায়। দেখি হেলিকপ্টার থেকে একের পর এক গোলাবর্ষণ হচ্ছে। বিদ্রোহীরাও হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। পরিস্থিতি যে এত মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, আগে বুঝতে পারিনি।

সীমান্ত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে আছি আমরা। জানতে পারলাম যেখানে গোলাবর্ষণ হচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশের মানুষও আছে। এলাকাটির নাম তুমব্রু বাজার। মিয়ানমারের কাঁটাতারঘেঁষা লোকালয়। মাঝখানে সবজি আর ধানখেত। কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিক শামীমুল ইসলামকে বললাম, সীমান্তের একদম কাছাকাছি যেতে চাই। সকাল থেকেই সীমান্তে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন শামীমুলরা। তিনি আমাকে সেখানকার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করলেন। কিন্তু অফিসে তো খবর পাঠাতে হবে। মানুষের সঙ্গে কথা না বললে কীভাবে পাঠাব। সাহস করে পাঁচটার দিকে বিজিবির তুমব্রু বিওপির (বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট) কাছাকাছি গেলাম। জায়গাটির ১৩০-১৫০ মিটার দূরেই কাঁটাতার। মুহূর্তে একটি গুলি এসে আমার থেকে ১০ গজ দূরে থাকা এক অটোরিকশাচালকের পায়ে লাগল। তাঁর নাম শামসুল আলম। স্থানীয় কয়েকজন তাঁকে অটোরিকশায় তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেল। মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজে কানে হাত দিলাম। গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও নেই, তাই দ্রুত এলাকা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

স্থানীয় লোকজন ওপারের সংঘর্ষ বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তাঁদের এবং বিজিবির বরাতে কিছু তথ্য পেলাম, তুমব্রু রাইট ক্যাম্প সীমান্তচৌকি দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি। সংঘর্ষে টিকতে না পেরে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) অন্তত ৬৮ জন সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সব গোছগাছ করে অফিসে রিপোর্ট পাঠালাম।

রাত ৯টার দিকে সীমান্ত থেকে উখিয়া সদরে ফিরে এলাম। উখিয়ায় থাকার মতো কোনো জায়গা পেলাম না। বাধ্য হয়ে চলে গেলাম কক্সবাজার।

মর্টার শেলের আঘাত এত ভয়াবহ

৫ ফেব্রুয়ারি সকালে খবর পেলাম, মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া সীমান্ত দিয়ে ২৫ জন বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে ঢুকেছে। বিজিবির ঘুমধুম বিওপিতে তাঁদের রাখা হয়েছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে সেখানে চলে গেলাম। কয়েক শ সাংবাদিকের ভিড়। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে শুরু হলো হেলিকপ্টার থেকে গোলাবর্ষণ। মনে হচ্ছে একেকটি গোলা মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। প্রচুর গোলাগুলি হচ্ছে। এর মধ্যেই ভিডিও ও ছবি তুললাম। সেখান থেকে সরে বেতবুনিয়া বাজারে অবস্থান নিলাম। বাজারে দুপুরের খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় খবর এল মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন মারা গেছে।

দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে গেলাম। মনটা বিষাদে ভরে গেল। নবী হোছাইন নামের এক বৃদ্ধের ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে আছে। নিহত হোসনে আরার অবস্থাও তা–ই। মর্টার শেলের একটি অংশ ঘটনাস্থল থেকে ২০ হাত দূরে খুঁজে পেলেন একজন। হোসনে আরার ছোট ছেলে কলেজপড়ুয়া মোহাম্মদ ইব্রাহীম রান্নাঘরের খুঁটি ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। একপর্যায়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে মূর্ছা যায়। তাঁকে চাচা আবদুর রহিম মাটি থেকে তুলে একটি চেয়ারে বসিয়ে দেন। অজান্তেই আমার চোখ ভিজে এল।

মর্টার শেলের আঘাত যে এত ভয়াবহ সেই প্রথম দেখলাম। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক। এলাকার নারী-পুরুষ ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। সবার অবস্থা এমন যেন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাচ্ছে।

গুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের পর তা বসতবাড়ি ও উঠানে এসে পড়ছে। এতে আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে গাড়ির অপেক্ষায় এক নারী, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে

দ্বিতীয় দিন থেকে উখিয়া সদরের একটি হোটেলে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো। ৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম অফিসের নিজস্ব প্রতিবেদক গাজী ফিরোজ ও আলোকচিত্রী জুয়েল শীল চলে এলেন। তাঁরা নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়ার সংযোগস্থল বালুখালী এলাকায় বাসা নিলেন। সেদিনই নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা থেকে একটু দক্ষিণ-পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। একের পর এক সীমান্তচৌকি দখল করে উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে এগোচ্ছে বিদ্রোহীরা। উখিয়ার পালংখালীর রহমতের বিল সীমান্ত এলাকায় চলে গেলাম। সকাল থেকেই থেমে থেমে এপারে এসে পড়ছে গুলি ও বোমা। সংঘর্ষের একপর্যায়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পার হয়ে এ দেশে ঢুকে পড়েন ১১৪ বিজিপি সদস্য।

রহমতের বিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একটু পূর্ব দিকে দাঁড়াই। আমার সঙ্গী ব্যবসায়ী বন্ধু সাদেক। বেলা ১১টার দিকে শুরু হয় মুহুর্মুহু গুলি। মনে হচ্ছিল আমাকে লক্ষ্য করেই যেন ছুড়ছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এর পূর্ব অংশে খোলা বিল, এরপরই সীমান্ত। দূরত্ব মাত্র আধা কিলোমিটার। দ্রুত আড়ালে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু গুলি এত বেড়ে গেল যে রাস্তার খাদে শুয়ে পড়তে হলো। দুজন জড়াজড়ি করে মাটিতে শুয়ে দোয়া–দরুদ পড়তে থাকলাম। কিন্তু গুলি আর থামে না। লোকালয়ের শেষ রাস্তা। এভাবে পৌনে এক ঘণ্টা পর সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরলাম।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বেতবুনিয়া বাজারে

সীমান্তবাসীদের ভালোবেসে ফেলেছি

৭ ফেব্রুয়ারিও কেটে গেল শঙ্কায়, ব্যস্ততায়। এর পরদিন থেকে সীমান্তে গোলাগুলি কমে এল। মনে হচ্ছিল বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে অফিসকেও অবহিত করলাম। দুদিন থাকার পরামর্শ দেওয়া হলো। ঠিকই তিন দিন শান্ত থাকার পর তুমব্রু সীমান্তে সংঘাত শুরু হলো। এভাবেই পেশাগত কাজ চালিয়ে নিতে থাকলাম।

১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের ৩৩০ নাগরিককে উখিয়ার ইনানীতে অবস্থিত নৌবাহিনীর জেটিঘাট থেকে ওপারে পাঠানো হলো। আজই বাড়ির পথ ধরব। গাড়িতে কক্সবাজারে যেতে যেতে মনে পড়ছে সীমান্তের মানুষদের কথা। ৭ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত এলাকা ঘুরে ঘুরে মানুষের কষ্ট, ভয়-আতঙ্ক নিয়ে প্রতিবেদন করেছি। এই কদিনেই অসহায় এই মানুষগুলোকে ভালোবেসে ফেলেছি। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের কারণে তাদেরকে কী খেসারতটাই না দিতে হচ্ছে।

সীমান্তে শান্তি আসুক, আমার উৎকণ্ঠিত পরিবারে নিরাপদ আশ্রয়ে যেভাবে ফিরে যাচ্ছি, এই মানুষেরাও সেভাবেই নিরাপদে আশ্রয়ে ফিরে যাক।