‘চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে দেখলাম এক বিস্ময়কর দৃশ্য’

‘দ্য লেট লেট শো’ থেকে বিদায় নিয়েছেন অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক জেমস করডেন—পশ্চিমা টিভি অঙ্গনে কয়েক দিন ধরে এটাই ছিল জরুরি খবর। শেষ পর্বে টম ক্রুজ, অ্যাডেলের মতো তারকা থেকে শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও অংশ নিয়েছেন। ‘দ্য লেট লেট শো’কে বিদায় বললেও বিখ্যাত এই ব্রিটিশ কমেডিয়ান, উপস্থাপক নিশ্চয়ই অন্য কোনো আয়োজনে দর্শকের নজর কাড়বেন। তাঁর যে নজর কাড়ার ‘বাতিক’ আছে, সে কথাই তিনি লিখেছেন মে আই হ্যাভ ইয়োর অ্যাটেনশন, প্লিজ? শিরোনামের আত্মজীবনীতে। পড়ুন বইয়ের ভূমিকার অনুবাদ।

জেমস করডেন
ছবি: উইকিমিডিয়া

আমি সব সময় ভাবতাম, একটা বইয়ের শুরুর কয়েকটা বাক্য লেখা সবচেয়ে কঠিন। কোথা থেকে শুরু করব? এমন একজনের কথা কীভাবে বলব, যাকে আমি চিনি না, কখনো যার মুখোমুখি বসিনি।

আমার জীবন! আমার গল্প! কেমন করে বলি? সত্যি বলতে জীবনের ‍দুই-তৃতীয়াংশ সময় তো প্লেস্টেশন খেলে আর ক্রাঞ্চি নাট কর্নফ্লেকস খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছি! গল্পটা মাঝখান থেকে শুরু করে মাঝেমধ্যে পেছনে ফিরে আসতে পারি। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ছবিটার মতো। ছবিতে আমরা আদালত থেকে শুরু করে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত নানা ঘটনা দেখেছি। আর এরই মধ্যে তৈরি হতে দেখেছি এমন এক ওয়েবসাইট, যা আমাদের সামাজিক যোগাযোগের ধারণা বদলে দিয়েছে।

আমার গল্প অবশ্য মা-বাবার ঘর থেকে আমার ঘর পর্যন্ত বিস্তৃত। মধ্যবর্তী সময়ে আমি বড়জোর একটা চিপস খেয়েছি।

সত্যি বলতে, আমি একটু অগোছালো অবস্থায় আছি। গতকাল ছিল ২২ মার্চ। যত দিন বেঁচে থাকব, দিনটা আমার মস্তিষ্কে গেঁথে থাকবে। কারণ, এই দিনে আমি বাবা হয়েছি। আমার সন্তানের ওজন ৭ পাউন্ড ৮ আউন্স, এটাই সম্ভবত জীবনের সেরা ঘটনা। ওর বয়স এখন ১ দিন। দেখে বেশ ভদ্রলোকই মনে হয়। যদিও এখনো জানি না, ওকে আমরা কী বলে ডাকব। এক সপ্তাহ আগেই ও দুনিয়াতে চলে এসেছে। মুশকিল হলো, বইটা লিখব বলে এই সপ্তাহটাই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম। অতএব কী আর করা। হাসপাতালে ওকে আর ওর মাকে ঘুম পাড়িয়ে, মন খারাপ করে আমি বাড়ি ফিরে লিখতে বসেছি। যখন বেরিয়ে আসছিলাম, মায়ের বুকে মাথা রেখে ও আরাম করে ঘুমাচ্ছিল। আর আমি ভাবছিলাম, জীবনের প্রথম স্মৃতি হিসেবে কোন ঘটনাটা ওর মনে থেকে যাবে?

নিজের প্রথম স্মৃতি আমার অবশ্য স্পষ্ট মনে আছে। সেই স্মৃতিটাই সম্ভবত আমার পরবর্তী জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছে।

আমার দুই বোন। আন্ড্রেয়া, যে আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। আর রুথ, চার বছরের ছোট। মা মার্গারেট একজন সমাজকর্মী। বাবা ম্যালকম ছিলেন বিমানবাহিনীর বাদ্যযন্ত্রী। এখন অবশ্য তিনি খ্রিষ্টধর্মীয় বই বিক্রি করেন।

যেদিনের কথা বলছি, সেদিন ছিল ছোট বোন রুথের নামকরণ অনুষ্ঠান। আমাদের পরিবার চার্চের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মা চার্চে কোরাস গাইত, আর বাবা বাদ্যযন্ত্র বাজাত। সেদিন কিছুক্ষণ কথা বলার পর যাজক আমাদের পুরো পরিবারকে বেদিতে তাঁর সঙ্গে দাঁড়ানোর আমন্ত্রণ জানালেন। মায়ের হাত ধরে আমি এগিয়ে গেলাম। বাবা ‍রুথকে যাজকের কোলে ‍তুলে দিলেন। আর আমরা তাঁকে ঘিরে অধবৃত্তাকার হয়ে দাঁড়ালাম। আমি যেহেতু খুব ছোট, তাই নামকরণের যজ্ঞটা ঠিক দেখতে পাচ্ছিলাম না। তখন যাজক একটা চেয়ার টেনে বললেন, ‘এসো জেমস, তুমি চেয়ারের ওপর দাঁড়াও। তাহলে দেখতে পাবে।’

জেমস করডেন

হাঁটুতে ভর করে আমি চেয়ার বেয়ে উঠে পড়লাম। চেয়ারে উঠে দাঁড়ানোর পরপরই একটা বিস্ময়কর দৃশ্য দেখলাম। সেই মুহূর্তটাই সম্ভবত আমার পুরো জীবন বদলে দিয়েছে।

ওই বয়সের স্মৃতি এত স্পষ্ট মনে থাকা কিংবা এত বিশেষ কিছু হয়ে ওঠাটা আপনাদের কাছে অতি নাটকীয়, অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু দিব্যি দিয়ে বলছি, এখনো মনে হয় যেন ঘটনাটা গতকালের। চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে আমি সেদিন দেখেছিলাম, হলভর্তি সারি সারি মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো সংখ্যাটা ৫০-এর বেশি হবে না, কিন্তু চার বছর বয়সী একটা ছেলের চোখে সেটাই জনসমুদ্র মনে হচ্ছিল। কথা ছিল আমি শুধু রুথের নামকরণের আনুষ্ঠানিকতাটুকু দেখব। কিন্তু আমার মনোযোগ চলে গিয়েছিল সামনে বসা মানুষগুলোর দিকে। বেদিতে কী হচ্ছে, সেদিকে আমার খেয়ালই ছিল না। মনে হচ্ছিল, আমি কোনো বেদিতে নয়, মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছি।

চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়েই আমি নানা রকম মুখভঙ্গি করতে শুরু করলাম। দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে ছোটখাটো একটা নাচও দিয়ে ফেললাম। টের পেলাম দর্শক হেসে উঠছে। উৎসাহ পেয়ে এবার আমি মাথা নিচু করে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে তাদের দিকে তাকালাম। যতক্ষণ আমার কসরত চলল, নামকরণের আনুষ্ঠানিকতার বদলে মানুষ আমার দিকেই তাকিয়ে থাকল। এমনকি বেদিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোও হাসছিল। কারণ, আমি ততক্ষণে একটা অদৃশ্য মাইক্রোফোন হাতে গান গাওয়ার ভঙ্গি করতে শুরু করেছি।

জানি না এ ঘটনা আমার ভেতরে কী পরিবর্তন এনে দিয়েছিল, কিন্তু খুব ভালো লাগছিল। সত্যিই ভালো লাগছিল। আনুষ্ঠানিকতা শেষে যাজক আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘ধন্যবাদ ছোট্ট জেমস। তোমার পরিবেশনা দারুণ ছিল!’ বাবা রুথকে মায়ের কোলে দিয়ে আমার হাত ধরতে ধরতে বলছিলেন, ‘বটে। বেশ একটা খেল দেখালে।’ হলভর্তি মানুষ হেসে উঠল, যেটাকে আমি বিজয়ের সূচক হিসেবে ধরে নিলাম। বাবার বাড়ানো হাত উপেক্ষা করে আমি লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে নামলাম। নিজের পায়ে দাঁড়াতেই সবাই করতালি দিল।

সেই মুহূর্তে, সেখানে দাঁড়িয়ে ওই পুঁচকে বয়সেও আমি টের পেয়েছিলাম, এর চেয়ে সেরা অনুভূতি আর হয় না। বেদি থেকে নেমে আমি মা-বাবার মাঝখানে গিয়ে বসলাম। মুখে ফুটল সবচেয়ে বড় হাসি। অদ্ভুত লাগছিল। মনে হচ্ছিল সারা গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

কী হলো? কী ঘটে গেল? আমি ভাবছিলাম। চেয়ারে বসার পর কয়েক সেকেন্ড যেতে না যেতেই আমি বিরক্ত হয়ে গেলাম। একটু আগেই কী অসাধারণ অনুভূতি হচ্ছিল, সেখান থেকে আবার এক ঝলকেই সেই সাধারণে ফেরা, ধ্যাৎ! যদি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, তাতে কী দারুণ অনুভূতিই না হয়! সেদিন থেকে প্রতি মুহূর্তে আমি সবার নজরে আসতে চেয়েছি। সবার মনোযোগ চেয়েছি। এমনকি আপনারও। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুদিত