ঢাকার শাহি ঈদগাহ, প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো এই পুরাকীর্তি।
ঢাকার শাহি ঈদগাহ, প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো এই পুরাকীর্তি।

ঐতিহ্য

ধানমন্ডির এই মাঠে ৪০০ বছর ধরে মুসল্লিরা ঈদের নামাজ পড়ছেন

ঢাকা মূলত মোগলদের গড়া রাজধানী। পরিবেশ তৈরিতে মোগলদের জুড়ি মেলা ভার। স্থাপনার সঙ্গে ভূমিরূপ ও গাছপালার সন্নিবেশন কেমন হতে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছে তারা। ‘চারবাগ’–এর ধারণা, নহরপ্রবাহ, অক্ষ—এসবই মনে করিয়ে দেয় মোগল স্থাপত্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস।

ঢাকা শহরে মোগলবাগানের পুঙ্খানুপুঙ্খ কোনো উদাহরণ আদৌ আছে কি না, আমার জানা নেই, তবে অসমাপ্ত আওরঙ্গবাদ দুর্গ (লালবাগ দুর্গ, ১৬৬৮ খ্রি.) যে চারবাগের আদলে গড়ে উঠেছিল, তার সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। যুক্তির মাধ্যমে তার অস্তিত্ব হয়তো মানা যাবে। বাংলাদেশে মোগল স্থাপত্যের সঙ্গে বাগান বা চারবাগ তৈরির আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। বাগান, স্থাপনা ও সাধারণের সমাগমস্থল সৃষ্টির মাধ্যমে স্থাপত্য পরিসরে অবদান রেখে গেছে মোগলরা।

এই যে বললাম ‘সাধারণের সমাগমস্থল’, এর গুরুত্ব ঢাকা তথা বাংলায় মোগল সুবেদাররাই প্রতিষ্ঠা করেন। বাগান উন্নয়ন, সেতু, নদীর ঘাট, হাম্মাম, কাটরা (আবাসিক হোটেল বা পান্থশালা) ও ঈদগাহের মতো স্থাপনা ও পরিবেশ উন্নয়নে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।

আমাদের আজকের লেখার বিষয় তেমনই একটি স্থাপনা, ঢাকার শাহি ঈদগাহ। ধানমন্ডির ৬/এ সড়কের পাশেই আছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো এই পুরাকীর্তি। এখনো এখানে ঈদের নামাজ আদায় করে মানুষ। মোগল আমলে বিশেষ এসব পাবলিক স্পেস এমনভাবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্থাপন করা হতো, যেন অন্য কাজেও তা ব্যবহার করা যায়। ঈদের নামাজ ছাড়াও মেলা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের একটি বড় জায়গা ছিল এই ঈদগাহ।

সাধারণত জলাশয়ের একপাশে গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা কোনো স্থানে গড়ে উঠত এ ধরনের সমাগমকেন্দ্র। ধানমন্ডির ঈদগাহটি যেমন পাণ্ডু নদের শাখার পাশে স্থাপন করা হয়েছিল। ময়দানটি থাকলেও নদটি আজ নিশ্চিহ্ন। এই ঈদগাহ নির্মাণের নেপথ্যে প্রধান ব্যক্তি ছিলেন মীর আবুল কাসেম। বাংলার সুবেদার সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার শাসনামলে তিনি ছিলেন দেওয়ান। ১৬৪০ সালে ঈদগাহটি নির্মিত হয়। মূল ঢাকা শহর থেকে (মানে মোগল বসতি থেকে) কিছুটা দূরে মোগল গণ্যমান্যদের জন্য এই ঈদগাহ স্থাপন করা হয়। কিন্তু ইসলাম তো ভ্রাতৃত্বের ধর্ম, সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়াটাই হয়তো উদ্দেশ্য ছিল। আজকে যেখানে সাতমসজিদ, সেখানে পাণ্ডু নদের শাখা বুড়িগঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। আমরা সবাই জানি, সাতমসজিদ একটি বিশেষ মোগল মসজিদ। আর এসব মোগল কীর্তিকে ঘিরেই ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে থাকে ধানমন্ডি এলাকা।

সত্তর ও আশির দশকে স্থাপনাটির শুধু পশ্চিম দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ ছিল

স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য

আয়তাকার স্থাপনাটির অন্তর্মুখী উঠানটি খোলা খিলানযুক্ত দেয়াল দিয়ে ঘেরা। মোগল–শৈলীর খিলানগুলো পলেস্তারা প্যানেলের সঙ্গে আবদ্ধ। তার ওপরে মুকুটের মতো সারি সারি মারলন প্যারাপেট। মোগল স্থাপত্যশৈলীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষর হলো রণসজ্জিত দুর্গের মতো অবয়ব। স্থাপনাটিতে একটু হলেও মোগল সমরশৈলীর সেই মেজাজ বিদ্যমান। যেমন মারলন প্যারাপেট, অষ্টকোণ মিনার, প্রবেশস্থানে দুর্গের মতো নকশা ও বিশেষ উচ্চতায় দেয়ালের অবস্থান। এই স্থাপনায়ও এগুলো বিদ্যমান।

সত্তর ও আশির দশকে স্থাপনাটির শুধু পশ্চিম দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ ছিল। পরে পশ্চিম দেয়ালের অনুকরণে নতুন করে নির্মাণ করা হয় বাকি তিনটি দেয়াল। পশ্চিম দেয়ালটি কেবলা নির্দেশক। এই দেয়াল আসলে মিহরাব। সুসজ্জিত মোগলখিলানে গভীর মিহরাব সৃষ্টির মাধ্যমে দেয়ালটি মুসল্লিদের সামনে থাকে। মসজিদে যেমন মিহরাব–দেয়ালে কোনো খোলা জানালা থাকে না, একই আদলে পশ্চিম দেয়ালটিতে কোনো ওপেনিং রাখা হতো না। এতে প্রার্থনায় একাগ্রতা সৃষ্টি হতো। দুই পাশে চৌদ্দ জোড়া বন্ধ মোগল খিলান সুসংগত শৈলীর অবতারণা করত। পাশে নদী থাকায় প্লাবন থেকে জায়গাটুকু রক্ষা করতে অপেক্ষাকৃত উঁচু ঢিবি তৈরি করে ময়দানটির নকশা করা হয়েছিল। এই ভিটার উচ্চতা আজও বিদ্যমান।

ঈদগাহটির নকশা করা হয়েছে কাতার তৈরির উপযোগী করে। উত্তর–দক্ষিণে বিস্তৃত নকশা লম্বা ও বড় কাতার তৈরিতে সহায়ক। নকশাটির এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে। ১৪৫ ফুট লম্বা আর ১৩৭ ফুট চওড়া এই ময়দানে আনুমানিক আড়াই হাজার মুসল্লি ঈদের নামাজ পড়তে পারেন।

৪০০ বছর আগের ঈদগাহ

শাহি ঈদগাহটি দুর্গরূপ, কিন্তু সাধারণ মানুষকে দূরে রাখতে পারেনি! পরিকল্পিত পাবলিক স্পেস হওয়ায় ৪০০ বছর আগেও ধানমন্ডির ঈদগাহ ছিল প্রাণচঞ্চল। সেই মোগল সময় থেকে ময়দানটি রাজকীয় অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সামাজিক আচার–অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। মোগল শাসকগোষ্ঠীর দরবারি বা শাহি আয়োজনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মিলনস্থল ছিল এ ময়দান। বাহারি রঙের শামিয়ানা ছায়া দেওয়ার মাধ্যমে পরিসরটাকে রাখত আরামদায়ক। মোগল-বাঙালির বিভিন্ন মেলার জন্য নির্ধারিত স্থান ছিল এই ময়দান। রংবেরঙের ছোট–বড় শামিয়ানার তলে বিভিন্ন পণ্যের পসরা নিয়ে বসত লোকজন।

শাহি ঈদগাহটি দুর্গরূপ

একধরনের সাংস্কৃতিক বলয়ের ধারাবাহিকতা তখন সাতমসজিদ পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছিল।

এখন কী অবস্থা

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় থাকলেও আজকের শাহি ঈদগাহ যে খুব ভালো আছে, এমনটা বলা যাবে না। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি সাইনবোর্ড বিদ্যমান। কিন্তু আমাদের একটি বিষয় বুঝতে হবে, ঐতিহাসিক স্থাপনা তালাবদ্ধ করে সাজিয়ে–গুছিয়ে ‘শোকেস’-এ দেখানোর ধারণাটি আজকের যুগে অচল। বরং এসব স্থাপনায় যত জনসমাগম করা যায়, তত ভালো। একটি ঐতিহাসিক স্থাপনাকে সঠিকরূপে অভিযোজিত করে পুনর্ব্যবহার করতে পারলে এর পুনরুজ্জীবন সুনিশ্চিত। মানুষের সাবলীল আসা–যাওয়া একটি ইমারতের জীবনরেখা দীর্ঘ করতে সহায়তা করে। এতে ঐতিহাসিক ইমারতটির সত্যিকার রক্ষণাবেক্ষণ হয়। আমাদের এই ঐতিহাসিক শাহি ঈদগাহটির তেমনই যত্ন দরকার। জনগণের জন্য সীমিত আকারে উন্মুক্ত করেও এর দৈনন্দিন রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব। সিটি করপোরেশন ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ যৌথভাবে উদ্যোগ নিলে ঢাকা শহরে পাবলিক স্পেসের অনন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে এই শাহি ঈদগাহ। ঈদ ও পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে নানা আয়োজন, ইসলামিক জলসা, লোকজ মেলা করে উন্মুক্ত পরিসরটিকে ঢাকাবাসীর গণজমায়েতের স্থান করার সুযোগ আছে।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, স্থাপত্য বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

লেখাটি বর্ণিল ঈদ ২০২৪ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত