২৫ বছর বয়সটা কেন বিশেষ

নদী ও রাব্বি দুই বন্ধু, শিগগিরই পা দেবেন ২৫–এ।
ছবি: সুমন ইউসুফ

মানুষের মস্তিষ্ক পরিপক্বতা পায় কত বছর বয়সে? অনেকেই হয়তো ভাবছেন, সংখ্যাটা ১৮। গবেষণা কিন্তু বলছে ভিন্ন কথা। বয়স ১৮ হলে আমরা তাঁকে ‘অ্যাডাল্ট’ বলি। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায়, শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে মানুষটি তারুণ্যে পা দিয়েছেন। তবে মস্তিষ্ক পুরোপুরি পরিণত হয় ২৫ বছর বয়সে। আবার কেউ কেউ বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ২৫ বছরের মধ্যেই আমরা জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো পেয়ে যাই বা তৈরি করে ফেলি।

কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী ব্যতিক্রমধর্মী একটি গবেষণা করেছিলেন। ৫৯ থেকে ৯২ বছর বয়সী ৩৪ জন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষকে এক করেন তাঁরা। জানতে চান তাঁদের জীবনের গল্প। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অধিকাংশই বলেছেন তাঁদের জীবনের ‘ট্রানজিশন পিরিয়ড’ বা পরিবর্তনের সময়গুলোর কথা। যেমন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়া, পড়ালেখার জন্য পরিবার ছেড়ে যাওয়া, প্রথম চাকরি, বিয়ে ইত্যাদি। ঘুরে ফিরে বয়সটা ২৫-এর আশপাশে ছিল।

নিউ হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের ডক্টরাল শিক্ষার্থী এবং এই দলের প্রধান গবেষক ক্রিস্টিনা স্টাইনার মনে করেন, ‘মানুষ যখন তাঁদের যাপিত জীবনের দিকে ফিরে তাকান এবং জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিগুলো খুঁজে ফেরেন, তখন তাঁরা নিজের জীবনের বিশেষ মুহূর্তের ওপর ভিত্তি করে জীবনকে কতগুলো অধ্যায়ে ভাগ করেন। এটা অনেকের কাছেই সর্বজনীন বিষয়।’

এ তো গেল বিদেশি গবেষণার কথা৷ বাংলাদেশের কিছু মানুষের ওপরও এ রকম জরিপ করা হয়েছিল। স্লেট ডটকমে প্রকাশিত এ জরিপে দেখা যায়, অতীত অভিজ্ঞতার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে মানুষ নিজের বর্তমানে তার প্রতিচ্ছবি দেখতে চায়। আর এ অভিজ্ঞতা অর্জনের সময়টা অনেকের কাছেই ২২-২৪ বছর।

২৫ বছর বয়স নিয়ে আমার খুব প্রিয় একটা উক্তি আছে। কথাটা বলেছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন—‘অনেকে ২৫ বছর বয়সেই মারা যায়। তাদের দেহটা সমাহিত করা হয় ৭৫ বছরে।’ অর্থাৎ এই যে দায়িত্ববোধ, কাজ, ভবিষ্যতের চিন্তা—এসবের চাপে আমরা অনেক সময় ২৫ বছর বয়সেই বেঁচে থাকার আনন্দ হারিয়ে ফেলি। এমনটা যেন না হয়। আমার আরেকটা প্রিয় উক্তি আছে। ‘অভিযোগ করা বন্ধ করে কাজ করা শুরু করো।’ আমি মনে করি, এটাই হওয়া উচিত জীবনের মূলমন্ত্র। সেটা যে বয়সেই হোক। যদি সব সময় নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে পারি, প্রতিদিন নিজেকে আগের দিনের চেয়ে আরেকটু উন্নত করতে পারি, তাহলে জীবন হবে রোমাঞ্চকর।
আয়মান সাদিক, সহপ্রতিষ্ঠাতা, টেন মিনিট স্কুল

এখন যাঁদের বয়স ২৫, তাঁদের কী মত? ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগ থেকে লেখাপড়া শেষ করেছেন বুশরা বিনতে জাকের। এখন একটি গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন। বুশরা বলছিলেন, ‘২৫ বছর বয়সটাকে জীবনের নতুন পর্বের প্রথম পাতাও বলা যায়। গত বছর আমি মা হয়েছি। মেয়ের ছোট্ট আঙুল ধরে শুরু হয়েছে নতুন এক পথচলা। ওকে কোলে রেখে পরীক্ষার আগে পিডিএফ পড়ার দিনগুলো বেশ মনে পড়ে। ওকে সঙ্গে নিয়েই সর্বোচ্চ ডিসটিংকশনসহ বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ করি। এই সবই আমার কাছে খুবই আপন, প্রতিটা মুহূর্তই যত্ন করে আগলে রাখি। এর আগে শৈশব, কৈশোর, স্কুলের স্মৃতি তো আছেই। সেরা অনেক মুহূর্তের হিসাব মিলে গেলেও সবার জীবনের পথ এক নয়। তবে ভালো-মন্দ মিলিয়েই নারীর জীবনের এ বয়স বেশ গুরুত্বপূর্ণ।’

বুশরা যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন, সেটাও কিন্তু তাঁর জীবনসংক্রান্ত। কোল আলো করে মেয়ে পৃথিবীতে আসার পর জানতে পারেন, জন্মগতভাবে মেয়ের মস্তিষ্কে কর্পাস ক্যালোসামের অংশ অনুপস্থিত থাকায় স্নায়ুর স্বাভাবিক গঠনে দেরি হতে পারে। কিছুটা ভেঙে পড়লেও সিদ্ধান্ত নেন, মেয়ের এ অসুখ নিয়েই গবেষণা করবেন। ২৫-এর উদ্দীপনা নিয়ে সারা দেশে এই অসুখসংশ্লিষ্ট সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে চান এই তরুণী।

মডেল: নদী ও রাব্বি

২৫ বছরের আরেক তরুণ তোজাম্মেল হোসেন। মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে লেখাপড়া শেষ করে এখন সুইস বায়োহাইজিনিক ইকুইপমেন্টসে প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে যুক্ত আছেন। ২৫-এর মধ্যে সেরা সব মুহূর্ত পেয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ একমত নন। নিজের জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি বিশ্লেষণ করলেন এভাবে, ‘আমার ছেলেবেলা কেটেছে দিনাজপুরের ছোট্ট এক গ্রামে। মাঠ দাপিয়ে খেলা, প্রথম স্কুল, নতুন বন্ধু—এসবই সুন্দর স্মৃতি। স্কুল শেষে ৪ বন্ধুর সাইকেল রেসের সেই টান টান উত্তেজনা এখনো স্মৃতিতে সতেজ। স্কুল টিফিনের সময়টায় টিফিন না খেয়ে সেই ৩০ মিনিটের মধ্যেই খেলে ফেলতাম এক রাউন্ড বাস্কেটবল।’ এই ছোট ও আপাত গুরুত্বহীন জিনিসগুলোই তাঁর কাছে এখন মনে হয় অমূল্য। এরপর পরিবার রেখে ঢাকায় এসে ভর্তিযুদ্ধ পার করে প্রকৌশলী হওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেও জমা হয়েছে দারুণ সব স্মৃতি। তবে তোজাম্মেলের যুক্তি, ‘বাংলাদেশের বাস্তবতায় জীবন পরিবর্তনের সময়টা শেষ হতে আরও কিছু বছর চলে যায়। যেমন একটা ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করতে করতেই হয় ২৮-৩০ বছর। অনেকের কাছে ২৫ বছর বয়সটা বরং একটু অনিশ্চয়তার, দ্বিধায় থাকার।’

দুজনই মনে করেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব বাড়তে থাকে। সব দায়িত্ব পালন করে নিখাদ, সুন্দর সময় পাওয়ার সম্ভাবনা কমতে থাকে। তাই ২৫-এর আগের সময়টা প্রাণভরে উপভোগ করা উচিত।