তিনটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড, দুটি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস—ডুয়া লিপার ঝুলিতে আছে বহু অর্জন। লন্ডনে বসবাসরত এই শিল্পী কেমন করে গায়িকা হয়ে উঠলেন? গল্পটা নিশ্চয়ই অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো।
বাবা ছিলেন একটা রক ব্যান্ডের সদস্য। তিনি অবশ্য দন্তচিকিৎসক হওয়ার জন্য পড়ালেখা করছিলেন। মা পড়ছিলেন আইন নিয়ে। কিন্তু যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধের সময়, ১৯৯২ সালে, তাঁরা কসোভো ছেড়ে লন্ডন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই একটি ঘটনাই আমাদের পুরো জীবন বদলে দিয়েছিল।
মায়ের গর্ভ থেকে বেরোনোর পরই আমার গান শোনার শুরু। জীবনটাই হয়ে উঠেছিল গানময়। মা-বাবা দুজনই সারা দিন গান গাইতেন, শুনতেন। কথা বলা শেখার আগেই অনেক শিল্পীর গানের ধরন আমার চেনা হয়ে গিয়েছিল। গান হয়ে উঠেছিল আমার দ্বিতীয় ভাষা।
মা-বাবা ডেভিড বোয়ি, এলটন জন, ওয়েসিস, ব্লার, ব্লন্ডির গান শুনতেন। তাঁদের অজস্র প্রিয় গায়কের গান শুনতে শুনতেই বেড়ে ওঠা। তবে ১০ থেকে ১১ বছর বয়সে আবিষ্কার করি আমার পছন্দের পপ শিল্পীকে। নেলি ফুরটাডো। নেলির হোয়া, নেলি! অ্যালবামটা জীবন বদলে দিয়েছিল। পিঙ্কের মিসআন্ডারস্টুড অ্যালবামটাও। অ্যালিসিয়া কিজকে ভালো লাগত। মনে মনে ভাবতাম, বড় হয়ে আমি ওদের মতো হব।
স্কুলের গানের দলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি, তখন আমার গলার স্বর বেশ চড়া ছিল। উঁচু গলায় কথা বলতাম। গানের গলাও ছিল তীক্ষ্ণ। তবে উঁচু মাত্রায় গাওয়ার সময় গলা নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল তখনো শিখিনি। তো শিক্ষক যখন বললেন, ‘কে কে অডিশন দিতে চাও?’ আমি এগিয়ে গেলাম। তিনি পিয়ানো বাজানো শুরু করলেন। তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমিও উঁচু মাত্রা (হাই নোট) স্পর্শ করার চেষ্টা করছিলাম। একটু পর টের পেলাম, গলা দিয়ে আওয়াজ নয়, শুধু বাতাস বেরোচ্ছে। কী লজ্জার ব্যাপার! তার ওপর ঘটনাটা ঘটছিল স্কুলের সমাবেশে। নানা বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমিই ছিলাম সবার সামনে। শিক্ষকের মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছিল, ‘পরেরবার নাহয় চেষ্টা কোরো।’
স্কুলে গানের দলে আমি কখনোই সুযোগ পাইনি। কিন্তু এটা আমার জন্য একটা বড় অভিজ্ঞতা ছিল। সেই অল্প বয়সেই আমি জেনে ফেলেছিলাম, তুমুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে দর্শকের সামনে দাঁড়ানোর পর কাঙ্ক্ষিত ফলাফলটা না পেলে কেমন লাগে।
এত কিছুর পরও গান গাইতে খুব ভালোবাসতাম বলেই মা আমাকে সিলভিয়া ইয়ং থিয়েটার স্কুলের শনিবারের ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন বয়স ৯। সে সময় একজন শিক্ষক ছিলেন, নাম রে। তিনি আমার গলার ওঠানামাটা খুব পছন্দ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তোমাকে আমি সকাল সাড়ে নয়টার ক্লাসে দিতে চাই।’ আমি জানতাম ক্লাসটা ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের জন্য। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, ‘বড়দের সঙ্গে আমি কীভাবে গাইব!’
রের জন্যই আমি নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলাম। বড়দের সঙ্গে গান গাওয়াটাও হয়ে উঠেছিল একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা। মা-বাবা সব সময়ই বলতেন, ‘তোমার গলা ভালো। তুমি ভালো গান গাইতে পারো।’ কিন্তু মা-বাবা ছাড়া তৃতীয় কারও কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া সেই বয়সে একটা বড় ব্যাপার।
মা-বাবা সব সময় কসোভোতে চাইতেন। যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, তখন তাঁরা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেললেন। ঠিক হলো, আমরা ফিরে যাব। ব্যাপারটা নিয়ে আমি অবশ্য ততটা মাথা ঘামাইনি। প্রাইমারি শেষে এমনিতেও আমাকে অন্য স্কুলে ভর্তি হতে হতো। বন্ধুরা যখন স্কুল বদল করছে, আমি দেশ বদল করলাম।
১৫ বছর বয়স পর্যন্ত কসোভোতেই কেটেছে। তত দিনে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তবে এরপরই মনে হতে শুরু করল, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে লন্ডনে ফিরতে হবে। এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে মা-বাবা আমাকে ঠেকাতে পারেননি। আমাদের এক পারিবারিক বন্ধু সে সময় লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে ভর্তির জন্য কসোভো ছেড়ে লন্ডনে চলে আসার পরিকল্পনা করছিল। ঠিক হলো, আমি তার সঙ্গে থাকব। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, আর আমি স্কুলে।
সে সময় দোকান থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁয় কাজ, এমনকি মডেলিংও করেছি। নিজের গান অন্যের কাছে পৌঁছানো তখন সহজ ছিল। ক্যামেরার সামনে বসে বলতাম, ‘হ্যালো, আমি ডুয়া। আমার বয়স ১৫। এখন আমি জোস স্টোনের “সুপার ডুপার লাভ” গাইব।’ ব্যস, হয়ে গেল।
একসময় একটা বিজ্ঞাপনে গাওয়ার সুযোগ এল। প্রযোজকের সঙ্গে টানা দুই সপ্তাহ কাজ করে গানটা দাঁড় করিয়েছিলাম। কাজ শেষে তিনি বললেন, ‘তুমি কি একটা গান লিখতে চাও?’ বললাম, ‘কেন নয়?’ তারপর আমরা দুজন একসঙ্গে লিখলাম। সপ্তাহখানেক তাঁর কোনো খোঁজ ছিল না। তারপর হঠাৎই আবার যোগাযোগ করে বললেন, ‘কী খবর! তোমার সঙ্গে একটা গান প্রকাশের চুক্তির ব্যাপারে আলাপ করতে চাই।’ আমার প্রতিক্রিয়া ছিল—‘গান প্রকাশের চুক্তি! সেটা আবার কী জিনিস!’
আমি তখন ইউটিউব, টুইটার ও সাউন্ডক্লাউডে গেয়ে অভ্যস্ত। অনলাইনেই ফেলিক্স জোসেফ নামের এক প্রযোজকের সঙ্গে পরিচয় ছিল। সে বলেছিল, ‘তুমি যদি কখনো স্টুডিওতে একসঙ্গে কাজ করতে চাও, আমাকে বোলো।’ যেহেতু চেনা আর কেউ নেই, আমি ফেলিক্সকেই ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম, ‘হাই ফেলিক্স। আমি জানি আমাদের কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু একটা সাহায্য প্রয়োজন। একজন আমার সঙ্গে গান প্রকাশের চুক্তির ব্যাপারে কথা বলতে চাইছে। আমি তো এসব কিছুই বুঝি না। তুমি কি বলতে পারো, কী করব?’ ফেলিক্সই বলল, ‘আগে তোমার একজন আইনজীবী প্রয়োজন।’
১৭ বছর বয়সে আমি লন্ডনের হ্যামারস্মিথের একটা ল ফার্মে যাই। আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ করি। তিনি বলেন, ‘এখনই সই কোরো না। আগে তোমার একজন ম্যানেজার লাগবে।’ গানের ব্যাপারে চুক্তি করার ভালো-মন্দ দিক, সবই তিনি আমাকে হাতে ধরে বুঝিয়েছিলেন। আর এভাবেই সবকিছুর শুরু।
সূত্র: হলিউডরিপোর্টার ডটকমে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার