প্রায়ই এ কথা আমরা শুনে থাকি, বয়স একটা সংখ্যামাত্র। মনের দিক থেকে যদি তরুণ থাকতে পারেন, তাহলে বয়স কোনো ব্যাপার নয়! কথাটি অনেকাংশে ঠিক। আবার চাইলেও আমরা সব সময় আমাদের বুড়িয়ে যাওয়া ঠেকাতে পারি না। কালের পরিক্রমায় বয়স বাড়ে, পরিবর্তন হয় আশপাশের। টগবগে তরুণও একসময় প্রবীণ হন। আমাদের জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী ষাট বছরের ওপর যাঁদের বয়স, তাঁরাই প্রবীণ হিসেবে অভিহিত হবেন। কিন্তু কেউ কেউ আরও বেশি দিন পর্যন্ত মনের তারুণ্য ধরে রাখতে পারেন। মনের তারুণ্য যখন একটু একটু করে ক্ষয় হতে থাকে, তখনই দেখা দেয় বার্ধক্য, বাড়তে থাকে বিষণ্নতাসহ মনের নানা সমস্যা।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। বার্ধক্যে কমবেশি সবারই ছোট-বড় সমস্যা দেখা দেয়। সবাই কেবল শারীরিক সমস্যার দিকে বেশি মনোযোগ দেন, যার ফলে মানসিক বিষয়গুলো উপেক্ষিত থাকে। বার্ধক্যে সাধারণত যেসব মানসিক সমস্যা বেশি দেখা দেয়, তা হলো, উদ্বেগ, বিষণ্নতা, ঘুমের সমস্যা, স্মৃতিভ্রম ইত্যাদি। ২০১৮ সালের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রবীণদের মানসিক রোগের হার অনেক বেশি। ৫০ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ব্যক্তিদের প্রতি ১০০ জনে ২২ জন আর ষাটোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে ২৮ জন কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক সমস্যার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
বার্ধক্যে মানসিক সমস্যা হওয়ার মূল কারণ দুটি। মনোসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ও দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগ।
মনোসামাজিক পরিবর্তনগুলোর মধ্যে রয়েছে—
সুনির্দিষ্ট কাজের অভাব: বার্ধক্যে কর্মক্ষমতা কমে যায়, স্বাভাবিক নিয়মে বা শারীরিক সমস্যার কারণে কাজ থেকে অবসর নিতে হয়। অবসরজনিত একঘেয়েমি একজন প্রবীণকে বিষণ্ন করে তোলে।
একাকিত্ব: পড়ালেখা বা পেশাগত কারণে বা বিয়ে করে সন্তানেরা দূরে চলে যান। বার্ধক্যে জীবনসঙ্গীর মৃত্যুও হতে পারে। ফলে একাকিত্ব পেয়ে বসে। পাখির বাসা থেকে একে একে সব পাখি উড়ে যেতে থাকে। এ অবস্থায় যে বিষণ্নতা হয়, তাকে বলে ‘এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম’।
আর্থিক সংকট: কাজ নেই। সঞ্চয়ও ফুরিয়ে আসছে। শুরু হয় আর্থিক টানাপোড়েন, যা উদ্বেগ, বিষণ্নতাসহ নানান মানসিক সমস্যা বাড়ায়।
সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা: দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে। চারপাশের পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। প্রজন্ম ব্যবধান থেকেও তাই দেখা দিতে পারে মানসিক সমস্যা।
শারীরিক পরিবর্তনের কারণেও হতে পারে বার্ধক্যে মানসিক সমস্যা। যেমন—
বয়সজনিত পরিবর্তন মেনে নিতে না পারা: বার্ধক্যে চুল পাকে, দাঁত পড়ে যায়, ত্বক শিথিল হয়ে যায়, হাড়ের ক্ষয় হতে থাকে, আগের চেয়ে শক্তি কমে যায়, দেখা দিতে পারে যৌন দুর্বলতা। এসব পরিবর্তন মেনে নিতে গিয়ে অনেক সময় মানসিক সমস্যা হয়।
দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগ: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হৃদ্রোগ, ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রম), ক্যানসার ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আর এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগ হলে মানসিক রোগের শঙ্কা থাকে।
খাদ্য ও পুষ্টিজনিত সমস্যা: বার্ধক্যে রুচির পরিবর্তন ঘটে, দেখা দেয় হজমের সমস্যা। খাদ্য গ্রহণে অনীহা হতে পারে। রক্তে খনিজ লবণ বা ভিটামিনের অভাব দেখা দিতে পারে, যা অনেক সময় মানসিক সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে।
ঘুমের সমস্যা: বয়স বাড়তে থাকলে ঘুমের অসুবিধা দেখা দেয়। ঘুম কম হয় বা রাতে ঘুম আসে না, কিন্তু দিনে ঘুম বেশি হয়। ঘুমের সমস্যা এক দিকে মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, আরেক দিকে মানসিক সমস্যা হলেও ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়।
তুচ্ছ কারণে রেগে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, একা একা কথা বলা, অহেতুক সন্দেহ, একই কাজ বারবার করা, একই কথা বারবার বলা—এসব লক্ষণ প্রবীণদের মধ্যে দেখা দিলে বুঝবেন, তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
মন খারাপ থাকা, নিজের শরীরের যত্ন না নেওয়া (গোসল না করা, দাঁত ব্রাশে অনীহা), সব বিষয়ে অনাগ্রহ, নিজেকে তুচ্ছ অর্কমণ্য ভাবা।
সাম্প্রতিক বিষয় ভুলে যাওয়া, স্থান–কাল–পাত্র সম্পর্কে ধারণা হারিয়ে ফেলা।
রাতে জেগে থাকা আর দিনে ঘুমানো।
খাবার গ্রহণে অনীহা, খেতে ভুলে যাওয়া, গুছিয়ে খেতে না পারা।
বিনা কারণে হাসা বা কাঁদা।
আগের মতো দায়িত্বশীল আচরণ করতে না পারা। নিজ স্বভাবের বিপরীত আচরণ করা। যেখানে যে কথা বলা ঠিক নয় সেখানে সে কথা বলা, কখনো কখনো কথা ও আচরণে শালীনতা বজায় রাখতে না পারা।
নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন না। সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিন। স্বজন–বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করুন।
প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটি করুন।
দিনের বেলায় বিছানায় শুয়ে থাকবেন না। দিনের বেলায় বিছানায় শুয়ে পত্রিকা পড়া, টিভি দেখা বন্ধ করুন।
ধর্মচর্চা, উপাসনা, ধ্যান, যোগব্যায়াম ইত্যাদি অনুশীলন করার চেষ্টা করুন।
বই পড়ুন, পছন্দের গান শুনুন, সিনেমা দেখুন।
সন্ধ্যার পর চা বা কফি পান করবেন না।
রাতে ঘুমানোর কমপক্ষে দুই ঘণ্টা আগে মুঠোফোন সরিয়ে রাখুন। ঘুমানোর আগে টিভি দেখা বন্ধ করুন।
ধূমপান ও মদ্যপান এড়িয়ে চলুন।
স্বজনদের করণীয়
কোনো প্রবীণের মধ্যে মানসিক সমস্যার কোনো লক্ষণ দেখা দিলে সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। ‘বয়স্ক মানুষ এমনই করবে’ বলে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। তাঁদের লক্ষণগুলো নিয়ে হাসিতামাশা করা যাবে না। বাড়ির প্রবীণ সদস্যকে গুণগত সময় দিন। তাঁর সঙ্গে কথা বলুন, তাঁর সুবিধা–অসুবিধাগুলো জানুন। তাঁদের প্রতি বিরক্ত হবেন না। প্রবীণ দম্পতিকে এক বাড়িতে একসঙ্গে রাখতে হবে। তাঁদের আলাদা বাড়িতে রাখবেন না। পরিবারের ছোটখাটো হালকা কাজের দায়িত্ব তাঁদের দিতে হবে, যাতে তাঁরা কখনোই নিজেকে অকেজো মনে না করেন। কোনো প্রবীণের প্রতি করুণা বা সহানুভূতি (সিমপ্যাথি) দেখানো যাবে না, এতে তাঁর মন আরও খারাপ হবে। বরং তাঁদের প্রতি সমানুভূতি (এমপ্যাথি) দেখাতে হবে। মানসিক সমস্যার লক্ষণ দেখা দিলে বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে মনোসামাজিক সহায়তা আর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।