কাওসার আহমেদ চৌধুরীর অপ্রকাশিত লেখা

যখন ঋত্বিক

২০১৯ সালের শেষ ভাগে আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তবে ‘ছুটির দিনে’র জন্য দুই পর্ব লেখার পর আগ্রহে ভাটা পড়েছিল। ‘অন্য কথা’ শিরোনামে প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল একই বছরের ২ নভেম্বর, আজ থাকল এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি

স্বাধীনতার পরপর দেশের সর্বত্র মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল। সাধারণত ওগুলো স্থাপন করা হতো পরিত্যক্ত কোনো বাড়িতে। আমারও ওই রকম একটা ক্যাম্প ছিল ঢাকার নিউ ইস্কাটন এলাকায়। পরিত্যক্ত একটি একতলা বাংলো বাড়ি। অন্যদের মতো আমিও তখন দালাল ধরে বেড়াচ্ছিলাম। দেশে শাসন-প্রশাসন বলে কিছু ছিল না। আমরাই সব চালাতাম। দালাল ধরে থানায় জমা দিতাম। এর বেশি কিছু করার হুকুম আমাদের ছিল না।

১৯৭২ সালের কোনো একদিন বাইরের কাজ শেষে ক্যাম্পে ফিরেছি। দেখি বন্ধু চিত্রগ্রাহক কাজলের পাশে বসে আছেন ময়লা জিনস ও পাঞ্জাবি পরা এক সুদর্শন পুরুষ। চোখে চশমা, মাথার চুল রুপালি। চেহারায় রাজপুরুষের আভিজাত্য। ভাবলাম, দালাল ছাড়ানোর তদবির করতে এসেছেন কেউ। উষ্কখুষ্ক চেহারা নিয়ে কড়া দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালাম। অমনি কাজল ছুটে এসে কানে কানে বলল, চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক!

তরুণ কাওসার আহমেদ চৌধুরী

আমার চুল দাড়ি খাঁড়া হয়ে গেল, তাঁকে তো আমি সারা জীবন ভেবেছি। তাঁর মেঘে ঢাকা তারা দেখে বিমুগ্ধ হওয়ার চেয়েও বেশি কিছু হয়েছি। সাধারণত কারও পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি না। এ ক্ষেত্রে আমি যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গিয়ে ঋত্বিক কুমার ঘটকের পদস্পর্শ করলাম। তিনি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে কাজলের দিকে তাকালেন। বললেন, যুদ্ধ তো শেষ। এখন তাহলে আবার এই সব বন্দুক-টন্দুক ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন?

এরপর থেকে তিনি এক মাসের বেশি আমার ক্যাম্পে থাকলেন। তখনকার দিনে ভারত ছাড়াও নানা দেশের মানুষ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ দেখতে আসত। কাজলের নিয়মিত কাজ ছিল ঢাকার পুরোনো বিমানবন্দরে গিয়ে কলকাতার সেলিব্রিটিদের সঙ্গে দেখা করা। যেদিনের কথা বলছি, সেদিন সে দেখে বিমানবন্দরের সিঁড়িতে ঋত্বিক ঘটক বসে আছেন। একই ফ্লাইটে সত্যজিৎ রায়ও এসেছেন। তাঁকে সবাই ফুলের মালা পরিয়ে নিয়ে গেছে। ঋত্বিকদাকেও নিতে চেয়েছিল। তিনি বলেছেন, তোমরা সত্যজিৎকে নিয়ে যাও। আমি এসেছি আমার জন্মভূমি দেখতে।

কাজল জিজ্ঞেস করল, দাদা, আমার সঙ্গে থাকবেন?

চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক

তিনি বললেন, চল।

এখানে বলে রাখি, এই ঢাকা শহরেরই জিন্দাবাহার লেনে ঋত্বিক ঘটকের জন্ম। বাবা ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের ডাকসাইটে আমলা। তাঁরা নাটোরের মহারানির বংশধর। দেশ বিভাগের পর প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় কলকাতায় চলে যান। তখন থেকেই তাঁর এক দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের শুরু। এসব কথা আমি শুনেছিলাম ঋত্বিকদারই জবানিতে। আমি জানতাম, দেশ বিভাগ ঋত্বিকদার বুকের একটি স্থায়ী ক্ষত।

ক্যাম্পের বেডরুমে আমি আর ঋত্বিকদা পাশাপাশি বিছানায় শুতাম।

এক রাতে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কী করিস?

আমি আমতা-আমতা করে বললাম, গান লিখি।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী

তিনি জোরে হেসে উঠে বললেন, গান লেখো হারামজাদা। গান যা লেখার সে তো লিখে চলে গেছে ওই দেড়ে ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথকে উনি দেড়ে অর্থাৎ দাড়িওয়ালা ঠাকুর বলতেন), নজরুল, লালন, মির্জা গালিব—এঁরা। তলায় যেটুকুন পড়েছিল, সেটা কুড়িয়ে নিয়ে গেছে প্রণব রায়, গৌরীপ্রসন্ন, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত—এঁরা। তুই আর গান লিখে কী করবি? তা ছাড়া গান কোনো কমপ্লিট আর্ট নয়। ফিল্মটা হচ্ছে বিজ্ঞান ও শিল্পের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা কমপ্লিট আর্ট।

মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম, আসলে দাদা, ফিল্মটাই হচ্ছে আমার জীবনের প্রথম আকর্ষণ। ভয়ে আপনাকে বলতে পারিনি।

তিনি বললেন, এ নিয়ে পড়াশোনা কিছু করেছিস?

আমি বললাম, খুব সামান্য কিছু পড়েছি। ভালো বইটই এখানে তেমন পাওয়া যায় না।

তিনি প্রশ্রয়ের সুরে বললেন, আগে দেখি তোর জ্ঞান কোন স্তরে আছে। তারপর দেখব কী করা যায়।

সবাই জানে ঋত্বিক ঘটক প্রায়ই অপ্রকৃতিস্থ থাকতেন। ওই অবস্থায়ও তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি, দাদা, বলুন তো ভারতবর্ষে শ্রেষ্ঠতম চিত্রনির্মাতা কে?

ঋত্বিকদা উত্তর দিতেন, সত্যজিৎ রায়। ও হচ্ছে চুলের আগা থেকে নখের ডগা পর্যন্ত কমপ্লিট আর্টিস্ট। তবে একটু দরজি টাইপ আরকি। খুব মেপে মেপে কাটে।

মাঝেমধ্যে বলতেন, আমার জন্মস্থান জিন্দাবাহার লেনে নিয়ে চল।

আমার হেফাজতে অনেক গাড়ি ছিল। তারই একটা রেডি করে বলতাম, আসুন দাদা।

কোমরে তোয়ালে প্যাঁচানো অবস্থায় বাইরে এসে গাড়িতে একটা লাথি দিয়ে বলতেন, এটা কে আনতে বলেছে! ঘোড়ার গাড়ি আন!

কিন্তু ঘোড়ার গাড়ি আমি কোথায় পাব? এভাবে কোনো দিনই আর তাঁকে ঘোড়ার গাড়িতে জিন্দাবাহার লেনে নিয়ে যাওয়া হয়নি।

নানান ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে এক মাস পার হয়ে গেল। সময় হয়ে এল ঋত্বিকদার কলকাতা ফিরে যাওয়ার। আমার নিজের একটা ফক্সওয়াগন ছিল। ওটাতে ঋত্বিকদাকে নিয়ে তাঁর তারুণ্যের রাজশাহী হয়ে ফারাক্কা বাঁধ পার হয়ে সাড়ে চার শ মাইল ঘুরে আমরা কলকাতায় গেলাম। সহযাত্রী ছিল মুক্তিযোদ্ধা সেবক।

ওখানে গিয়ে কাটল আরও এক মাস। ওখানকার চলচ্চিত্র জগতের অনেক কিছু দেখালেন ঋত্বিকদা। তিনি চেয়েছিলেন আমাকে ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভর্তি করতে। চেয়েছিলেন আমি যেন তাঁর যুক্তি তক্কো আর গপ্পো ছবিতে অভিনয় করি। সেসব কিছুই আর হয়নি। আসলে ঋত্বিকদার সঙ্গে আমার জীবনটা এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল যে এক পর্বে সে কাহিনি শেষ হওয়ার নয়। ঋত্বিক প্রসঙ্গ তবে আজ এই পর্যন্তই থাক।