আমাদের পরিবারে বাবা, ভাইবোনেরা বই পড়তেন, ছোটরাও পড়ত, নেশাগ্রস্তের মতো। কোনো রকমের কোনো বই পড়তে আমাদের বাধা ছিল না। হাতের কাছে যে সংগ্রহ পেতাম—সেগুলো পড়তাম, হাতের নাগালের বাইরে যেগুলো ছিল, সেগুলোও পড়তাম।
আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে, তখনকার পড়া আমার প্রথম বড় গল্পের বই হচ্ছে মীর মশাররফ হোসেনের লেখা বিষাদ–সিন্ধু। বইটি আমি রাত জেগে জেগে শেষ করেছিলাম। এর ঠিক পরের বইটাই ছিল পাশের বাড়ির স্নেহময়ী রানিদির কাছ থেকে পাওয়া মহাভারত। এ ছাড়া বোনের সংগ্রহে যে সমস্ত বই ছিল তার সবই আমি একে একে পড়ে ফেলি। যত পড়ি ক্ষুধা আমার তত বাড়ে।
এগুলো যখন পড়ি, তখন আমি ওই বোনের সঙ্গে থাকি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে। তখন কুমিল্লা জেলায় ছিল, একবারে প্রত্যন্ত গ্রাম। মনে পড়ে, ওখানকার মসজিদে আমাকে ভোরের আজান দিতেও শেখানো হয়েছিল। ওটাও ছিল আমার জন্য এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ইমাম সাহেব আমাদের বাসায় থাকতেন, আমার সঙ্গে একই ঘরে। রাত ভোর না হতেই তাঁর লাঠির খোঁচা দিয়ে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিতেন। ওটা ছিল আমার কাছে একটা অত্যাচার। তখন বোনের সংগ্রহ থেকে পড়া ব্ল্যাক ম্যাজিকের একটা বই থেকে জানলাম, কারও বালিশের নিচে ভেড়ার লোম লুকিয়ে রাখলে সহজে তাঁর ঘুম ভাঙে না।
সেই মতো হাজীগঞ্জ বাজার থেকে ভেড়ার লোম কুড়িয়ে এনে রাত্রি বেলায় হুজুরের বালিশের নিচে রেখে দিলাম। ভাবলাম, দেখা যাক এবার কী হয়। কিন্তু ভোররাতে আবার দেখি বুকের পাঁজরে হুজুরের লাঠির খোঁচা আর ভর্ৎসনা। এ থেকে বুঝলাম—ওসব ব্ল্যাক ম্যাজিক ফ্যাজিক বলে কিছুই নেই।
বাড়িতে বাবার কাছে, ভাইবোন বন্ধুদের কাছে চিঠিপত্র লেখার অভ্যাসটা তখনই রপ্ত করেছিলাম। ভাবের এই আদান-প্রদান আমাকে প্রচুর আনন্দ দিত। যা-ই হোক, এভাবে এরপর তো একসময় ফিরে এলাম সিলেটে বাবার সংসারে।
বাবা কার সঙ্গে যেন গল্প করছিলেন, মহাত্মা গান্ধী খুব অল্প বয়স থেকে ডায়েরি লিখতেন। আমিও ডায়েরি লিখতে শুরু করলাম, যখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, বয়স ১১। আমার ওই বয়সে বড় ভাই অর্থাৎ কলি ভাই ইংল্যান্ডে চলে যান। তাঁর বড় দুটি বইয়ের আলমারির মালিকানা দিয়ে যান আমাকে। তিনি জানতেন, ওসব বইয়ের ওপর আমার লোভ আছে, কেননা সুযোগ পেলেই ওখান থেকে আমি রিডার্স ডাইজেস্ট, টাইম, নিউজ উইক ইত্যাদি ম্যাগাজিন পড়তাম। ওই বইয়ের মধ্যে এক সেট বই আমি পাই, যেগুলোর প্রচ্ছদে হাতের ছবি আঁকা। আমি আমার পাঁচ বছরের বড় বোনকে জিজ্ঞেস করি: বুবু, এগুলো কী ডাক্তারি বই? বুবু হেসে জবাব দেন: না, এগুলো ভাগ্য গণনার বই। ভবিষ্যৎ জানার বই।
এইভাবে তীব্র একটা কৌতূহল থেকে আমার জ্যোতিষশাস্ত্র শেখার শুরু। একদিকে বই পড়তাম, অন্যদিকে মানুষের হাত দেখে সেগুলো মিলিয়ে দেখতাম। সংখ্যার ব্যাপারটাও বুঝতে চেষ্টা করতাম। আমার এক বয়সে বড় বন্ধু ছিল, সম্পর্কে ভাগনে, নাম সাদ গাজী। ডাকনাম বাচ্চু। চিন্তাচেতনায় ও আমার চেয়ে অনেক অগ্রগামী ছিল। বইগুলো যেহেতু ইংরেজি, ও আমাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিত। ১৪ বছর বয়সে আমি ও বাচ্চু মিলে বইপত্র ঘেঁটে মেডিটেশন বা ধ্যান সম্পর্কে ধারণা নিই।
আমি জ্যোতিষশাস্ত্র শেখার শুরুতে, মাঝখানে এবং পরেও অনেক ইন্টারেস্টিং ঘটনার সম্মুখীন হই। এখানে তা সবিস্তারে বলার অবকাশ নেই। পরবর্তী সুযোগে বলব। তবে, এটুকু বলে রাখি, গোড়াতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম—জ্যোতিষশাস্ত্রের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো যোগ নেই। জ্যোতিষশাস্ত্রটা নেহাতই একটা হাইপোথিসিস বা অনুমানসিদ্ধ শাস্ত্র। ছোটবেলায় এক জ্যোতিষী আমার হাত দেখে বলেছিলেন: তোর লেখাপড়া হবে না। তুই জীবনে কিছুই করতে পারবি না। কথাটা শুনে আমার প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল। মনে হয়েছিল, ওই অর্ধশিক্ষিত ভদ্রলোককে সুযোগ পেলে আমি বুঝিয়ে দেব—কেবল ইচ্ছাশক্তি থাকলেই মানুষ সব কাজ করতে পারে। এর জন্য অন্য কিছুরই দরকার হয় না।
জ্যোতিষী যার সাফল্যের ভবিষ্যদ্বাণী করেননি, তিনিও কি কখনো সফল হোন না বা হতে পারেন না? জ্যোতিষী যার ব্যর্থতার কথা বলেন, তিনি কি ব্যর্থ হন?
প্রিয় পাঠক, প্রতি শনিবারে আমি আপনার সাপ্তাহিক রাশিফলে যা-ই লিখি না কেন, ওটাকে আপনি সব সময়ই পজিটিভ অর্থে ধরবেন। দুঃখ–কষ্টকে জয় করবেন। সাফল্যের পথে এগিয়ে যাবেন। আপনার এগিয়ে যাওয়ার পথে সব সময়ই আমি পাশে থাকব। জয় হোক আপনার।