যখন মহাকাশে গেছি, কাজের ফাঁকে জানালায় তাকিয়ে দেখেছি লাখো তারা

সুনিতা উইলিয়ামস একজন মার্কিন মহাকাশচারী। প্রায় ৯ মাস মহাকাশ স্টেশনে আটকে থেকে কিছুদিন আগেই পৃথিবীতে ফিরেছেন তিনি। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সমাবর্তনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন এই বিজ্ঞানী। পড়ুন তাঁর বক্তব্যের নির্বাচিত অংশ।

সুনিতা উইলিয়ামস
ছবি: উইকিপিডিয়া

অভিনন্দন। জীবনের একটা দারুণ সময় তোমরা পার করছ। সীমাহীন সুযোগ তোমাদের সামনে। স্বপ্নের পেছনে ছুটতে কতটা পরিশ্রম করতে তুমি রাজি আছ, সেটাই একমাত্র প্রশ্ন। পরের অভিযান তোমাকে কোথায় নিয়ে যায়, দেখতে আমরাও মুখিয়ে আছি। তবে আমার দৃষ্টিতে, তোমাদের প্রত‍্যেকের জন‍্যই অপেক্ষা করছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

এবার আমার দুনিয়া থেকে কিছু কথা তোমাদের বলি। মহাকাশ নিয়ে কাজ করার খুব ভালো সময় এখন। আজ তোমাদের সামনে কথা বলছি; কারণ, একদিন আমিও ফ্লোরিডা টেকেরই অংশ ছিলাম। আমার খুব সৌভাগ্য, মহাকাশকে জানার ও নাসার মহাকাশচারী হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। কত কী ঘটছে মহাকাশ ঘিরে। নতুন মহাকাশযান, নতুন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মহাকাশ নিয়ে নতুন স্বপ্ন। মঙ্গলগ্রহে মানববসতির প্রস্তুতিও চলছে। অতএব কাজের অঢেল সুযোগ তোমাদের সামনে।

মহাকাশে কাজ করে, থেকে, প্রশিক্ষণ নিয়ে যা শিখেছি; সেসবের কিছু অংশই আজ তোমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেব। মাত্র তিনটি পরামর্শের কথা বলব। অতএব আশা করি, তোমাদের মনে রাখতে কষ্ট হবে না।

স্টার্টিং লাইনে দাঁড়িয়ে যাও

প্রথমত, দৌড়ের ‘স্টার্টিং লাইনে’ দাঁড়িয়ে যাও। সত‍্যি বলতে, যখন তোমাদের জুতায় আমার পা ছিল, নিজেও জানতাম না গ্র্যাজুয়েট হয়ে শেষ পর্যন্ত কী করব। তবে কিছু বিষয় মনে মনে ঠিক করেই রেখেছিলাম। যেমন এক—নৌবাহিনীতে অন্তত ৫ বছর কাজ করব। দুই—ফ্লাইট স্কুলে ভর্তির চেষ্টাটাও থাকবে। ছোট একটা এয়ারক্রাফট আমি আগে চালিয়েছি। কিন্তু পেছনের সিটে বসে আমার ঘুম পাচ্ছিল। তাই আমার ধারণা ছিল পাইলট হওয়া আমার কম্ম নয়। তবু একবার চেষ্টা করতে চেয়েছি।

তার মানে আমার স্টার্টিং লাইন ঠিক করাই ছিল। নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার পাইলট হিসেবে আমি যাত্রা শুরু করি। হেলিকপ্টার ওড়াতে আমার ভালো লাগত। কিন্তু খুব আশাহত হলাম, যখন অনেকে আমাকে বলল, মহাকাশচারী হতে হলে জেট পাইলট হতে হবে। বললাম, ‘কেন! চাঁদে কি আমরা অনুভূমিকভাবে অবতরণ করেছিলাম?’ আমি সেখানেই থেমে যেতে পারতাম, আর কখনো চেষ্টা না করলেও পারতাম। কিন্তু যেকোনো দ‍ৌড়েই স্টার্টিং লাইনে দাঁড়ানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এখানেই ফ্লোরিডা টেক আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হলে প্রকৌশলে আমার একটা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দরকার।

এফআইটির জীবনটা সহজ ছিল না। রাতের পর রাত জেগে পড়তে হয়েছে। এমন অনেক কিছুও পড়েছি, যার কথা আগে কখনো শুনিওনি। যেমন সিএফডি (কম্পিউটেশনাল ফ্লুইড ডায়নামিকস)। এই পড়ালেখাই আমাকে স্টার্টিং লাইন থেকে দৌড়টা শুরু করতে সাহায‍্য করেছে।

কিন্ডারগার্টেনে যা শিখেছিলে, ভুলে যেয়ো না

অন‍্যের প্রতি সদয় থাকো, ভাগাভাগি করতে ভুলো না। সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ। দলের সাফল‍্য মানেই সত‍্যিকার সাফল‍্য। মহাকাশে যাওয়াটাও কিন্তু একটা দলীয় খেলা। কেউ একা একা মহাকাশে যেতে পারে না। দলের দেখভাল করতে হয়, একে অপরের যত্ন নিতে হয়।

কখনো কখনো নিজের যত্ন নেওয়াটা কঠিনও হয়ে যায়। ভাবো তো, জীবনে প্রথমবার মহাকাশে গেছ। জানালা দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে পাচ্ছ। ভেসে বেড়াচ্ছ, ভাবছ বাহ্, আমি তো জিমনাস্টদের চেয়ে কম নই, বেশ ‘কুল’ একটা ব্যাপার! আর ঠিক তখনই হঠাৎ তোমার শরীরটা ওপরের দিকে আছড়ে পড়ল। সব ছড়িয়ে–ছিটিয়ে একটা ভজঘট অবস্থা।

এ সময় যখন নিজেকে অসহায় মনে হবে, দেখবে তোমার কোনো না কোনো সতীর্থ এসে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলবে, ‘তুমি একটু বিশ্রাম নিয়ে এসো। আমি সামলে নিচ্ছি।’

পাতাগুলোর দিকে তাকাও

তৃতীয় পরামর্শটা আমার বাবার কাছ থেকে পাওয়া। থামো আর পাতাগুলোর দিকে একবার তাকাও।

হ্যাঁ, স্টারলাইনার মহাকাশযানের প্রথম যাত্রার পাইলট আমি। হ্যাঁ, এটা একটা দারুণ ব্যাপার। কিন্তু আমরা এই যাত্রার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছি সেই ২০১৫ সালে। এটা কিন্তু কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা নয়, এটা একটা ম্যারাথন। আমাদের রকেট উৎক্ষেপণের তারিখ যতবার পিছিয়েছে, ততবার আমরা এমন কিছু শিখেছি, যা আগে জানতাম না। এই সময়ের মধ্যে আমরা আমাদের ধারণাগুলো আরও ঝালাই করে নিয়েছি—কীভাবে ওড়াব, কীভাবে মহাকাশযান পরিচালনা করব, প্রয়োজন হলে কীভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসব। এ জন্যই বলছি, গাছের চেয়ে আমরা পাতাগুলোই বেশি দেখি।

বারবার আমাদের উৎক্ষেপণ পিছিয়েছে, একে আমরা চাইলে ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে পারতাম। কিন্তু আমরা দেখেছি, কীভাবে স্পেসএক্সজুড়ে আমাদের আঙুলের ছাপ ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা দেখেছি, আমাদের তরুণ প্রকৌশলীরা কীভাবে একটু একটু করে পুরো কাজের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে; প্রথমবার ওড়ানোর চ্যালেঞ্জ ওরা নিজের করে নিয়েছে। আমরা দেখেছি, পুরো দলটা শুধু মহাকাশযানটা ওড়ানোর চেষ্টাই করছে না, বরং পরিবারের সদস্যর মতোই আমাদের নিরাপত্তার কথা ভাবছে।

আমি যখন মহাকাশে গেছি, কাজের ফাঁকে জানালায় তাকিয়ে দেখেছি লাখো তারা। দেখেছি অসাধারণ মেঘজ্যোতি। যদি একটা মুহূর্ত না থামতাম, যদি জানালায় না তাকাতাম, হয়তো এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা হতো না। মহাকাশের মতো আমাদের চারপাশেও এমন অনেক কিছু আছে, যেসবের প্রশংসা আমাদের করা উচিত। না থামলে আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোকে হারিয়ে ফেলতে পারি। তাই তোমাদের জীবনের এই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দিনেও একবার থামো, আর আশপাশে তাকাও। দেখো, কারা তোমাকে আজকের দিনে আসতে সাহায্য করেছে।