জুলাই বিপ্লবে আহত হয়েছিলেন বহু শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে একজন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের তকী মাহমুদ। পড়ুন তাঁর অভিজ্ঞতা।
১৭ জুলাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে প্রথম আন্দোলন হলেও সেটা আমি জানতাম না। ব্যক্তিগত কাজে তখন ছিলাম নিজ শহর চট্টগ্রামে। সেদিন রাতেই খবরটা কানে এল। এমন অবস্থায় ঘরে বসে থাকি কী করে? ঢাকার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম।
বের হয়ে পড়লাম আরেক বিপদে। রাস্তায় ঢাকাগামী কোনো বাস নেই। শেষে এক পিকআপ-ভ্যানচালককে অনুরোধ করে, কিছু বকশিশ দিয়ে পিকআপের পেছনে বসে কুমিল্লা পর্যন্ত এলাম। এরপর আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ঢাকাগামী একটা বাসের সন্ধান পেলাম। সেটাতে করেই সকাল নয়টায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে নামি। নেমেই দেখি শিক্ষার্থী ও পুলিশের জটলা।
ভাবলাম এই ফাঁকে ব্যাগটা বাসায় (বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই আমার বাসা) রেখে আসি। মিনিটখানেক পর এসে দেখি, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে। একপর্যায়ে পুলিশ মারমুখী হলো, আমাদের ওপর টিয়ারশেল ছুড়তে থাকল। চোখ-মুখ ঢেকে আমরা ক্যাম্পাসের ভেতর আশ্রয় নিলাম। একসময় ক্যাম্পাসের ভেতরেও তারা টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে শুরু করল। নিজ ক্যাম্পাসের ভেতরেই শ্বাস নিতে কষ্ট হবে, কোনো দিন ভেবেছিলাম!
শেষে সারা মুখে টুথপেস্ট মেখে প্রাথমিকভাবে একটু স্বস্তি পেলাম। একসময় পুলিশপ্রধান সড়কের পাশেই কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে অবস্থান নেয়, সেখান থেকে গুলি করতে থাকে। আমরা কেউ সামনে এগোনোর মতো অবস্থায় ছিলাম না। একটু পরপর কেউ না কেউ আহত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে যাচ্ছিলেন।
একসময় ভাবলাম, যদি সামনে এগোতে পারি, তাহলে বাকিরাও সাহস পাবে। অনেকটুকু এগিয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক তখনই গায়ে এসে কী যেন লাগল। প্রথম ঝটকায় কিছু টের পাইনি। ভেবেছিলাম হয়তো সাউন্ড গ্রেনেড। কিন্তু পেছন থেকে সবাই বলা শুরু করল, ‘ভাই, রক্ত পড়ছে!’ গায়ে হাত দিয়ে দেখি সত্যিই তাই। পুরো শার্ট ভিজে গেছে। আমি রক্তাক্ত অবস্থাতেই সামনে এগোলাম, আমার দেখাদেখি আরও অনেকে এল। পুলিশের অবস্থান তখন কিছুটা নড়বড়ে। এভাবেই চলল প্রায় আধঘণ্টা।
সহপাঠীরা জোর করে আমাকে ক্যাম্পাসের চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখি আরেক ভয়াবহ দৃশ্য। কারও মুখে অক্সিজেন মাস্ক, কারও কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। একজন ডাক্তার আমার স্প্লিন্টারগুলো বের করে দিচ্ছিলেন। কিন্তু এত বেশি ভিড় তখন, তিনি কাকে ছেড়ে কাকে সাহায্য করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। শেষে অবস্থা বেগতিক দেখে নিজেই বললাম, ‘আমাকে একটা চিমটা জাতীয় কিছু দেন, আমিই বের করি। আপনি বাকিদের দেখেন।’
একটা চিমটার সাহায্যে মাংসের নিচ থেকে ছোট ছোট স্প্লিন্টার বের করতে শুরু করলাম, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে। স্প্লিন্টার হলো একধরনের ছোট ছোট ডালের দানার ধাতব বল। এগুলো একেবারে চামড়ার নিচে ঢুকে যায়।
পরে গুনে দেখেছি ৪৯টি স্প্লিন্টার লেগেছে পুরো শরীরে। সব কটি তখনই বের করার মতো অবস্থা ছিল না। যে কয়টা সম্ভব বের করে আবার মাঠে নেমে পড়ি। শার্ট ঘামে ভিজে থাকায় গায়ে রাখতে পারছিলাম না, আর পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় শার্ট খুলেই লাঠি হাতে নেমে পড়ি।
সেদিনের আন্দোলন শেষ হলো। আমার শরীরের সব স্প্লিন্টার কিন্তু তখনো বের করা হয়নি। চিকিৎসকের কাছে যে যাব, সেই উপায়ও নেই। কারণ, আন্দোলনে আহত হয়ে কেউ চিকিৎসকের কাছে গেলেই, তার বিস্তারিত নোট রাখা হচ্ছিল। পরে পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হতে পারে, এই ভেবে আর যাওয়ার সাহস হয়নি। দুদিন পর আবিষ্কার করলাম, মাথায়ও স্প্লিন্টার গেঁথে ছিল, খেয়ালই করিনি এত দিন। অনেক কসরত করে সেগুলো বের করতে হলো।
এরপর এল ৫ আগস্ট, সরকারের পতন হলো। আমার আসলে আলসেমি করেই আর ডাক্তার দেখানো হয়নি। স্প্লিন্টার শরীরে যা ছিল, সব তো নিজেই বের করে ফেলেছি! আর এখানেই ছোট্ট একটা ভুল হয়ে গেছে। এই লেখাটা যখন লিখছি, তার কিছুক্ষণ আগেই টের পেয়েছি—বুকে ও হাতের নির্দিষ্ট দুইটা ক্ষত শুকালেও কেমন যেন অস্বাভাবিক ফোলাভাব রয়ে গেছে। বুঝলাম, দুইটা স্প্লিন্টার তখনো রয়ে গেছে। সেগুলোও বের করেছি।
এখন সুস্থ আছি। ক্ষতগুলো শুকিয়ে গেলেও দাগ সম্ভবত রয়ে যাবে। আমার দেশটা যখন বিপদে ছিল, আমি বাসায় বসে থাকিনি, চেষ্টা করেছি। সেই প্রচেষ্টার পাক্কা ৪৯টি স্মৃতি নাহয় থাকল শরীরে, থাকুক না!