১টি ওয়ার্ড, ১টি সিসিইউ আর ২০টি বেড নিয়ে বাংলাদেশে হৃদ্রোগ চিকিৎসার সূচনা করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার অধ্যাপক ডা. আবদুল মালিক। পরে তাঁর হাত ধরেই গড়ে ওঠে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠান। দেশে হৃদ্রোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ আজ সকালে ৯৪ বছর বয়সে মারা গেলেন। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোর স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ আয়োজন ‘বর্ণিল ভালো থাকুন ২০২২’–এ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
১৯৫০ সাল। আবদুল মালিক তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ। সামনে কয়েক দিনের ছুটি। তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলেন গ্রামের বাড়ি যাবেন। হোস্টেল থেকে সোজা ফুলবাড়িয়া স্টেশন। ট্রেনের টিকিট কাটার সময় কেন যেন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল তরুণ মালিকের মন। মনে হতে লাগল, ট্রেনটা দুর্ঘটনায় পড়বে। কম্পার্টমেন্টে বসে বন্ধুদের বললেনও সে কথা।
আর কী আশ্চর্য, সত্যি সত্যিই সেদিন দুর্ঘটনায় পড়ল তাঁদের ট্রেন। ভৈরব রেলস্টেশনের আগে ছোট একটা নদীর পুল ভেঙে ট্রেনের ইঞ্জিন আর সামনের বগি নদীতে গিয়ে পড়ল। কোনোমতে বগি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন তিন বন্ধু। সাঁতরে পাড়ে ওঠেন। অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে ফেরার ঘটনাটি সেদিন তাঁর মনে গভীরভাবে দাগ কেটে গিয়েছিল। আবদুল মালিক বুঝেছিলেন, জীবন অনিত্য, অনিশ্চিত। আর তাই খুবই মূল্যবান। জীবনকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে।
সত্যিই কাজে লাগিয়েছেন তিনি। কাটিয়েছেন কর্মময় বণার্ঢ্য এক জীবন। এখন দেশে এত যে হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ, হাতের কাছেই হৃদ্রোগ চিকিৎসার সর্বাধুনিক সুযোগ–সুবিধা, এর পেছনের কারিগর অধ্যাপক মালিক।
১৯২৯ সাল। সিলেট সদর থানার (বর্তমান দক্ষিণ সুরমা উপজেলা) নোয়াগাঁও গ্রামে জন্ম অধ্যাপক আবদুল মালিকের। তাঁদের গ্রামে কোনো বিদ্যালয় ছিল না। পৌঁছায়নি বিদ্যুৎ। একটু বড় হওয়ার পর তাঁকে ভর্তি করা হয় কয়েক মাইল দূরের শ্রীরামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যেতে হতো পায়ে হেঁটে। সেই বিদ্যালয়ে চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ বলতে কিছুই ছিল না। চাটাইয়ে বসে ক্লাস করতে হতো। সাধারণ এই স্কুলই গড়ে দেয় অধ্যাপক মালিকের জীবনের ভিত।
আবদুল মালিক তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। একদিন স্কুল পরিদর্শনে এলেন এক পরিদর্শক। ক্লাসে এসে পাঁচটা মানসাঙ্ক করতে দিলেন। সব কটির সঠিক উত্তর দিয়ে পরিদর্শককে চমকে দিলেন ছোট্ট মালিক। পরিদর্শক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বলে গেলেন, ছেলেটি যেন বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। শুধু অংশগ্রহণ নয়, সেই পরীক্ষায় বৃত্তিও পেয়েছিলেন তিনি।
এ সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে মালিককে সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে ভর্তি করে দিল তাঁর পরিবার। ভর্তি হওয়ার পর চার মাসের বৃত্তির ১২ টাকা একসঙ্গে পেয়ে আনন্দ আর ধরে না। সে সময় তা ছিল অনেক টাকা। এক পয়সায় একটা মিষ্টি পাওয়া যেত। বৃত্তির টাকা দিয়ে দাদি, মা এবং পরিবারের অন্যদের জন্য অনেক কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরেছিলেন মালিক। শৈশবের সেই প্রাপ্তি আর আনন্দের কথা মনে করে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর মুখ!
রাজধানীর শ্যামলীতে নিজের পুরোনো বাড়ির বৈঠকখানায় বসে শৈশবের স্মৃতিচারণা করে চলেন আবদুল মালিক। এখন তাঁর বয়স ৯৩ বছর। অনেক আগেই নিয়মিত চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ডা. আবদুল মালিক। কিন্তু অবসরে গিয়েও তাঁর অবসর নেই। এই বয়সেও নানা কাজের মধ্যে থাকতে ভালোবাসেন। খানিকটা হেসে বললেন, ‘মানুষ তার জন্মের জন্য মোটেও দায়ী নয়, বুঝলে? কিন্তু তার কর্মের জন্য অবশ্যই দায়ী। তাই যে যেখানে জন্ম নিয়েছে, যেখানে আছে, যে কাজ করছে, তা যেন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে করে, সেটাই সবচেয়ে বড় কর্ম। জীবনে সেটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।’
এই বয়সেও স্মৃতিশক্তি প্রখর। সাল–তারিখ সব নির্ভুল বলে দিতে পারেন। বৃত্তির অর্থে মিষ্টি কেনার গল্পের এক ফাঁকে বললেন, চিরকাল কম টাকাপয়সা আর সীমিত অর্থবিত্তেই সুখী ছিলেন তিনি। প্রচুর কাজ করেছেন, প্রচুর ছোটাছুটি, নানা উদ্যোগ-উদ্যম, কিন্তু টাকার পেছনে ছোটেননি তেমন। একসময় নিজের বাড়ির নিচতলায় কিছু রোগী দেখতেন। এ ছাড়া তেমন কোনো প্রাইভেট প্র্যাকটিস ছিল না। মাথাজুড়ে ছিল শুধু কীভাবে দেশে হৃদ্রোগ চিকিৎসা ও এ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা-প্রশিক্ষণের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যায়।
হৃদ্রোগ বিষয়ে এ অঞ্চলে কোনো ধারণাই যখন গড়ে ওঠেনি, সে সময় হৃদ্রোগের চিকিৎসক হয়েছেন অধ্যাপক মালিক। কীভাবে সম্ভব হলো, শোনালেন সেই গল্প।
১৯৫৪ সাল। এমবিবিএস পরীক্ষার আগে আগে তাঁর জীবনে মর্মান্তিক এক ঘটনা ঘটল। লিউকেমিয়ায় মারা গেলেন ছোট ভাই আবদুল কাদির। খুব ভেঙে পড়লেন আবদুল মালিক। এই বেদনার মধ্যেই এমবিবিএস পরীক্ষায় অংশ নিলেন। কৃতিত্বের সঙ্গে পাসও করলেন। ইন্টার্ন শেষ করে যোগ দিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে। সেনাবাহিনীতে কেন?
জানালেন, শৈশবেই বাবা মারা গিয়েছিলেন। এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আবদুল মালিকের তাই মনে হলো, একটা নিশ্চিত জীবন দরকার, যেখানে আর কারও সাহায্য, সহযোগিতা দরকার হবে না। তখন একমাত্র সেনাবাহিনীর চিকিৎসকদেরই প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মর্যাদা দেওয়া হতো। সেনাবাহিনীতে দলবাজি–তদবিরও তেমন ছিল না। শিক্ষা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন ছিল। তাই পরিবারের মানুষ খুব একটা না চাইলেও সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন আবদুল মালিক। তারপর প্রশিক্ষণের জন্য চলে গেলেন লাহোর।
লাহোরে প্রচণ্ড গরম। আবহাওয়া মোটেও বাংলাদেশিদের উপযুক্ত নয়। জুন মাসেও এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। চারদিক রুক্ষ, শুষ্ক। কোনোমতে খাপ খাইয়ে নিতে নিতেই যেতে হলো রাওয়ালপিন্ডি। সেখানে আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে তিন মাসের প্রশিক্ষণ। তারপর নানা জায়গা ঘুরে মেডিকেল স্পেশালিস্টের প্রশিক্ষণ শেষ হলো। এরপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন সিএমএইচ ক্যাম্বেলপুরে। তরুণ চিকিৎসকের কাজে মুগ্ধ হন কনসালট্যান্ট ফিজিশিয়ান জেনারেল আইয়ুব ও কনসালট্যান্ট সার্জন জেনারেল শওকত। তাঁর কাজের প্রশংসা করে ভালো রিপোর্ট দেন তাঁরা। সেই সঙ্গে বিলাতে এমআরসিপিসহ উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য সুপারিশও করেন।
১৯৬৩ সালে এমআরসিপি করতে স্কটল্যান্ডে যান ডা. মালিক। পড়াশোনা শুরু করেন এডিনবরার ওয়েস্টার্ন জেনারেল হাসপাতালে। তখন বিলাতের তিনটি জায়গায় এমআরসিপি পরীক্ষা দেওয়া যেত—লন্ডন, এডিনবরা ও গ্লাসগো। ডা. মালিক দেন গ্লাসগোতে। পরীক্ষা শেষ করে চলে আসেন লন্ডনে। ঠিক সেই সময় রাওয়ালপিন্ডিতে কার্ডিয়াক সেন্টার খোলার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান সরকার। সেখানে কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে অধ্যাপক মালিকের কথাই ভাবে তারা।
এ সিদ্ধান্তের পর লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতালে তিন মাসের কার্ডিওলজি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাঁকে। এরপর আরও প্রায় এক বছরের প্রশিক্ষণ শুরু করেন হ্যামার স্মিথ পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল স্কুলে। সেখানে ডা. মালিকের প্রশিক্ষক ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসর জে এফ গুডউইন।
১৯৬৫ সাল ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পাকিস্তান থেকে বার্তা গেল ডা. মালিকের কাছে। জানানো হলো, যেকোনো সময় তাঁকে ডাকা হবে। তখন প্রশিক্ষণের মাত্র ৯ মাস সম্পন্ন হয়েছে, আরও বাকি ৩ মাস। প্রশিক্ষণ শেষ না করেই ফিরে যেতে হবে ভেবে মন খারাপ হলো। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁকে ডাকা হয়নি। অনেক পরে জেনেছেন, তাঁর শিক্ষক প্রফেসর গুডউইন পাকিস্তানের একজন জেনারেলকে অনুরোধ করেছিলেন আবদুল মালিককে যেন মাঝপথে দেশে না নেওয়া হয়। কারণ, একজন যোদ্ধার চেয়ে পাকিস্তানে একজন হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ বেশি দরকার।
হ্যামার স্মিথের পর সুইডেনের বিখ্যাত ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটে আরও এক মাস প্রশিক্ষণ শেষে রাওয়ালপিন্ডিতে কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক মালিক। এখানেই তৈরি হয় পাকিস্তানের প্রথম কার্ডিয়াক সেন্টার। হাল ধরেন দুজন—পশ্চিম পাকিস্তানের কার্ডিয়াক সার্জন কর্নেল আকরাম আর পূর্ব পাকিস্তানের (পরে বাংলাদেশ) অধ্যাপক আবদুল মালিক।
১৯৭০ সালের মার্চ মাসে রাওয়ালপিন্ডি কার্ডিয়াক সেন্টারে সম্পন্ন হয় সমগ্র পাকিস্তানের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি। সেই খবর গুরুত্বের সঙ্গে পত্রপত্রিকায় ছাপা হলো। পাকিস্তান সরকার এ জন্য কর্নেল আকরাম ও অধ্যাপক আবদুল মালিককে জাতীয় পুরস্কার দিয়েছিল। সে বছরই তাঁকে মেজর থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত করা হয়। কিন্তু বরাবরই তাঁর মনে হচ্ছিল, যত চিকিৎসাসুবিধা, যত উন্নতি সব পশ্চিম পাকিস্তানেই হচ্ছে, সব রকম সুযোগ–সুবিধা থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। কেন এমন হবে? প্রেসিডেন্ট হেডকোয়ার্টারে কাজ করা জেনারেল পীরজাদা ছিলেন অধ্যাপক মালিকের রোগী। তাঁকে বারবার এ কথা বলে একসময় রাজি করিয়ে ফেলেন অধ্যাপক মালিক। তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে ডেপুটেশনে পাঠাতে রাজি হলো কেন্দ্রীয় সরকার। মেজর জুলফিকারকে রাওয়ালপিন্ডি কার্ডিয়াক সেন্টারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন অধ্যাপক মালিক।
১৯৭০ সালের জুনে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে কার্ডিওলজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ডা. আবদুল মালিক। এর কয়েক মাস পরই তো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, তাই না? মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিতেই যেন বিষণ্ন হয়ে পড়লেন অধ্যাপক মালিক।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ। কারফিউ উঠে গেছে। পিজিতে কর্মস্থলে যাওয়ার সময় দেখলেন, হাইকোর্টের সামনে ড্রেনের মধ্যে মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। হাসপাতালে আহত রোগী। এক নারকীয় অভিজ্ঞতা হলো তাঁর। ১৯৭১ সালের পুরোটা সময় তিনি পিজিতেই ছিলেন, দায়িত্ব পালন করেছেন।
পিজিতে দায়িত্ব পালনের সময় দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন আবদুল মালিক। বিদেশি অনেক রাষ্ট্রীয় অতিথির সঙ্গে মেশারও সুযোগ হয়। মনে করে বললেন, সাবেক যুগোস্লাভিয়ার রাজনৈতিক নেতা প্রেসিডেন্ট জোসেফ মার্শাল টিটোর কথা। স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নৌবিহারে গিয়েছিলেন। সেখানে সফরসঙ্গী হয়ে গিয়ে আবদুল মালিক দেখেন, মার্শাল টিটোর সঙ্গে কয়েকজন চিকিৎসকও এসেছেন। তিনি অবাক, এত চিকিৎসক কেন? তাঁরা জবাব দিয়েছিলেন, ‘“তিনি আছেন বলেই যুগোস্লাভিয়া টিকে আছে, আমরা কোনোভাবেই তাঁকে হারাতে চাই না!” আর আমরা? কয়েক বছর পরই আমরা হতভাগ্য জাতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে হারালাম!’
স্বাধীনতার পর হৃদ্রোগের চিকিৎসার সুযোগ বলতে ছিল কেবল পিজি হাসপাতালের ১টি ওয়ার্ড, ১টি সিসিইউ আর মোটে ২০টি বেড। অধ্যাপক আবদুল মালিকের সে সময়কার প্রধান ভাবনা ছিল, কীভাবে একটা পৃথক হৃদ্রোগ হাসপাতাল করা যায়, যেখানে চিকিৎসার পাশাপাশি জনশক্তি উন্নয়ন, মানে হৃদ্রোগে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকবে।
ডা. আবদুল মালিকের ভাবনার কথা জেনেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং তাঁর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তাঁরা প্রস্তাবে রাজি হলেন। তবে শুরুতে নতুন দালানকোঠায় বিনিয়োগ না করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পুরোনো ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ভবনে হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট চালুর সিদ্ধান্ত হয়। অর্থসাহায্যের জন্য জাপান থেকে একটি প্রতিনিধিদল আসে। তারা জানায়, হৃদ্রোগ ধনীদের রোগ, এর জন্য কোনো সাহায্য দেওয়া যাবে না। অধ্যাপক আবদুল মালিক তখন তাদের বোঝাতে সক্ষম হন যে এটি কেবল ধনীদের রোগ নয়, বাতজ্বরজনিত হৃদ্রোগ গরিব ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার রোগীদেরই হয়। উচ্চ রক্তচাপ গরিব–ধনী যে কারও হতে পারে। তিনি প্রতিনিধিদলকে বলেন, ‘আপনার পিজিতে আসুন, দেখে যান, এটা গরিবদেরও হয়।’
সত্যি তারা পিজিতে যায়। ওয়ার্ডগুলো দেখে টের পায় যে হৃদ্রোগে গরিবেরাও আক্রান্ত হয়। শেষ পর্যন্ত জাপানের দলটি যন্ত্রপাতি দিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করে। এ সময়ই পরিসংখ্যান ও গবেষণার গুরুত্ব বুঝতে পারেন অধ্যাপক মালিক। দেশে হৃদ্রোগীদের ওপর কোনো তথ্য–উপাত্ত নেই বলেই দাতাগোষ্ঠীকে বোঝানো কঠিন। ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের সহায়তায় ঢাকার আশপাশের গ্রাম ও শিল্প এলাকায় জরিপ করা হয়। এতে দেখা যায়, হৃদ্রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আছে উচ্চ রক্তচাপ, তারপর বাতজ্বর ও বাতজ্বরজনিত হৃদ্রোগ। সেই থেকে এখন পর্যন্ত দেশের হৃদ্রোগের বড় বড় গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন অধ্যাপক মালিক।
১৯৮০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটি। হৃদ্রোগ চিকিৎসার মান উন্নয়ন আর হৃদ্রোগ নিয়ে গবেষণাই যার মূল উদ্দেশ্য। গড়ে তুলেছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট।এখানে হৃদ্রোগে দক্ষ জনশক্তি, চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা কার্যক্রম চালু আছে। তাঁর উদ্যোগেই জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে এবং পরবর্তী সময়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে চালু হয় হৃদ্রোগের উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রি।
১৯৭০ সালে বাংলাদেশের একমাত্র কার্ডিওলজিস্ট বা হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন অধ্যাপক আবদুল মালিক। বর্তমানে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশের নানা প্রান্তে চিকিৎসা দিয়ে চলেছেন তিন শতাধিক হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন। যদিও হৃদ্রোগীর তুলনায় এখনো দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অপ্রতুল।
বাংলাদেশে হৃদ্রোগ চিকিৎসার এই বিস্ময়কর যাত্রার গল্প শুনতে শুনতে বেলা গড়িয়ে আসে। আমাদের সামনে বসা ৯৩ বছরের এক তরুণ, এখনো যিনি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি হিসেবে কাজ করে চলেছেন। বাড়িতে বসেই ইন্টারনেটে মিটিং করছেন, নানা পরামর্শ দিচ্ছেন, সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, অংশ নিচ্ছেন নানা সেমিনার, সভা, একাডেমিক কার্যক্রমে।
তারপরও জানতে চাই, কীভাবে সময় কাটান? হেসে বলেন, ‘কোভিডকালে ইন্টারনেটের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি ভালো করে।’ তখন থেকেই তাই ক্রমাগত শিখে চলেছেন। জুম মিটিং, গুগল ক্লাস ইত্যাদি কীভাবে করতে হয় শিখছেন। এসব শিখতে তাঁকে সাহায্য করেন একজন তরুণ। এই বয়সেও তাঁর শেখার আগ্রহ আর স্পৃহা আমাদের মুগ্ধ করে। শুধু তা–ই নয়, কোভিডের সময়টা বাড়িতে বসে থেকে নষ্ট না করে লিখে ফেলেছেন আত্মজীবনী জীবনের আরও কথা। এটাই একমাত্র নয়, আরও ছয়টি বই লিখেছেন তিনি, যার গ্রন্থস্বত্ব ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও অনুল মালিক ট্রাস্টকে দিয়েছেন।
নতুন প্রজন্মের চিকিৎসকদের প্রতি তাঁর উপদেশ, ‘যে কাজই করো, তাতে যেন আন্তরিকতা, একনিষ্ঠতা আর নৈতিকতাবোধের অভাব না থাকে। আমার দ্বারা যেন কারও কোনো ক্ষতি না হয়, এটা সব সময় মনে রাখতে হবে। আর দিন শেষে একজন মানুষের কাজই তাকে স্বীকৃতি আর সম্মান এনে দেয়, তাই অন্য কিছুর পেছনে না ছুটে নিজের কাজটাই ভালোভাবে করে যেতে হবে।’