প্রযুক্তির বিপ্লব আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ ও উন্নত করার পাশাপাশি কিছু সংকটও তৈরি করেছে। ক্রমশ বাড়তে থাকা সাইবার বুলিং যার মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ভয়ানকভাবে প্রভাবিত করছে। আজ ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। বিশেষ এই দিনে জেনে নেওয়া যাক কাদের ওপর সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে সাইবার বুলিং। আর আমাদের করণীয়ই–বা কী।
বিনোদন থেকে শুরু করে পড়াশোনার জন্যও শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনকার সময়ের একটা বড় অংশ কাটে ইন্টারনেটে। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে ইন্টারনেটের পরিসরও এখন অনেক বড়। কৌতুক করার নামে ট্রল, আক্রমণাত্মক মিম, বডিশেমিং, মিথ্যাচার, অনলাইনের দুনিয়ায় দল বেঁধে চেহারা ও অন্যান্য শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কটু কথা বলা—এমন সব ঘটনা বেড়েই চলেছে।
‘বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ট্রেন্ড ২০২৩’–এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশে রিপোর্ট করা সাইবার অপরাধের মধ্যে ৫২ শতাংশই ছিল সাইবার বুলিং। আর এর বড় একটা অংশের শিকার হলো স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থী। সাইবার বুলিং এমন ব্যাপক আকার ধারণ করার পেছনে রয়েছে সামাজিক আর মনস্তাত্ত্বিক কারণ। যেমন ধর্মের অপব্যাখ্যা, অতিরিক্ত রক্ষণশীলতা, সংবেদনশীলতা ও শিক্ষার অভাব ইত্যাদি। এ ধরনের হয়রানির সবচেয়ে ভয়ানক ফল হলো মানসিক বিপর্যয়। হতাশা, মানসিক চাপ, হীনম্মন্যতা, আত্মবিশ্বাসহীনতা ও একাকিত্বসহ বিভিন্ন মানসিক রোগে ভোগেন ভুক্তভোগীরা। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাসও কমে যায়। যে কারণে তাঁদের সামাজিক আচরণও বদলে যায়।
বুলিংয়ের শিকার শিশু-কিশোরদের মানসিক এই অবস্থা সব সময় বাইরে থেকে বোঝাও যায় না। অথচ মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ, আত্মসম্মানের অভাব ও একাকিত্বের মতো সমস্যা তাঁদের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে যায়। একজন কিশোর বা কিশোরীর জন্য এ ধরনের মানসিক চাপ অত্যন্ত ক্ষতিকর। কেননা এগুলোর সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ বা পাত্তা না দেওয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতা এই বয়সে তাঁদের ভেতর থাকে না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর স্বাভাবিক বিকাশ। এগুলো কখনো কখনো তাদের মধ্যে প্রতিহিংসার মনোভাব তৈরি করে। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হলো, সাইবার বুলিংয়ের কারণে আত্মহননের পথও বেছে নেন কেউ কেউ।
দেশের সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাইবার অপরাধ রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে কাজ করছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। কিছু আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে শুধু এ পদক্ষেপ গ্রহণই যথেষ্ট নয়। সমাজের বড় একটি অংশ এখনো এই সমস্যার প্রকৃত গভীরতা বুঝতে পারেনি। এই সংকট প্রতিরোধে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রয়োজন মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা। স্কুল থেকেই শিশুদের ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। ডিজিটাল শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের সহমর্মিতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশের কিছু স্কুলে ইতিমধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। যেমন শিক্ষার্থীদের মানসিক ও আবেগীয় স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সোশ্যাল ইমোশনাল লার্নিং (এসইএল) ক্লাস চালু করেছে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিশু ও তরুণ শিক্ষার্থীদের মানবিক ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এমন পাঠ্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কুমকুম হাবিবা জাহান, হেড অব জুনিয়র স্কুল, গ্লেনরিচ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা।