লৌহ বা আয়রন আমাদের শরীরের অন্যতম অতি প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান। রক্তের লোহিত কণিকা তৈরির কাঁচামাল। এর অভাবে লোহিত কণিকা তৈরি হতে পারে না। তাই রক্তশূন্যতার অন্যতম প্রধান কারণ আয়রনের ঘাটতি। কিন্তু আয়রন শুধু রক্তকণিকা তৈরি করে না, দেহের শক্তি উৎপাদন থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের স্নায়ুপ্রবাহও নির্ভর করে পর্যাপ্ত আয়রনের উপস্থিতির ওপর। তাই দেহে আয়রনের ঘাটতি হলে দেখা দিতে পারে বহুবিধ সমস্যা।
রক্তশূন্যতা আয়রন ঘাটতির সর্বশেষ স্তর। জেনে নিন, আয়রন ঘাটতি হলে আর কী কী উপসর্গ দেখা দিতে পারে—
১. শারীরিক দুর্বলতা।
২. মাথাব্যথা/মাথা ঘোরানো।
৩. মনোযোগ কমে যাওয়া।
৪. স্মরণশক্তির ঘাটতি।
৫. মাংসপেশিতে ব্যথা।
৬. অস্থিসন্ধিতে ব্যথা।
৭. চুল পড়ে যাওয়া।
৮. বুক ধড়ফড় করা বা বুক ভার হয়ে থাকা।
৯. শ্বাসকষ্ট।
১০. স্থূলতা।
১১. রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম অর্থাৎ পা/হাতে শিরশির অনুভূতি হাওয়া, পা চিবানো, পায়ে নিস্তেজ ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এ ছাড়া আয়রনের অভাবজনিত কারণে গলার মধ্যে কিছু আটকে থাকা, নখ বেঁকে যাওয়া, খাবার গিলতে কষ্ট হওয়া, খাদ্য নয় এমন খাবারে আসক্তি ইত্যাদিও হতে পারে।
আয়রন ঘাটতি হলে অবশ্যই এর কারণসমূহ জানতে হবে। যেমন: খাবারে আয়রন ঘাটতি হচ্ছে কিনা, বিশেষ করে যাঁরা নিরামিষভোজী। শরীরে আয়রনের চাহিদা বাড়লে যেমন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বা দুগ্ধ দানকারী মাকে বাড়তি সাপ্লিমেন্ট খেতে হতে পারে। পরিপাকতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ যেমন সিলিয়াক ডিজিজ, ইনফ্লেমেটরি বাওয়েল ডিজিজ বা আইবিডি, দীর্ঘদিন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ নেওয়া, পাকস্থলীর সার্জারির পর, দীর্ঘদিন পরিপাকনালি থেকে রক্ত নির্গমন (যেমন অর্শ বা পাইলস), কৃমি সংক্রমণ, দীর্ঘদিন ব্যথার ওষুধ সেবন এবং রক্ত পাতলা করার ওষুধ খেলেও হতে পারে আয়রন ঘাটতি।
আয়রনের ঘাটতি আমরা খুব সহজেই প্রতিরোধ করতে পারি। আয়রন রয়েছে এমন খাবার যেমন কলিজা, মাছ, হাঁস-মুরগির মাংস, সবুজ শাকসবজি বিশেষ করে পালংশাক, কুমড়োর বীজ, ব্রকলি, ড্রাই ফ্রুট (যেমন কিশমিশ), অ্যাপ্রিকট, বাদাম, ডালিম, কলা, আপেল ইত্যাদি খাবার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। মানবদেহে আয়রন পরিশোষণের জন্য ভিটামিন সি অপরিহার্য। তাই খাদ্যতালিকায় আয়রনযুক্ত খাবারের পাশাপাশি ভিটামিন সি যুক্ত খাবারও রাখতে হবে। বাড়ন্ত বয়সে আয়রনের চাহিদা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকে, তাই বাড়ন্ত বয়সে আয়রনসমৃদ্ধ খাবার বেশি রাখতে হবে।
নিয়মিত বছরে ১/২ বার কৃমিনাশক ওষুধ নিতে হবে। কৃমি যাতে না হয় এ জন্য ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি (যেমন বাথরুম করার পর সাবান দিয়ে হাত ভালোভাবে ধোয়া, খালি পায়ে না থাকা ইত্যাদি) মেনে চলতে হবে। দীর্ঘদিন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ এবং আয়রন সাপ্লিমেন্ট একসঙ্গে খাওয়া যাবে না। ন্যূনতম ১ থেকে ২ ঘণ্টার বিরতি রাখতে হবে। পাইলসজনিত রোগ থেকে বাঁচতে বেশি করে পানি, শাকসবজি খেতে হবে যাতে কোষ্ঠকাঠিন্য না হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ডাক্তার দেখিয়ে আয়রন ঘাটতিজনিত রোগ নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া।
শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দিলে শুধু আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খেলে হবে না, আয়রন সাপ্লিমেন্ট নিতে হবে। আয়রন সাপ্লিমেন্ট দুভাবে দেওয়া যায়। এক. আয়রন ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের মাধ্যমে। দুই. শিরা পথে আয়রন ইনজেকশন।
সাধারণত আয়রন ঘাটতি হলে মুখে খাবার ওষুধ দিয়ে পূরণ করা যায়। কিন্তু এই কারণগুলোর কোনোটা থাকলে শিরাপথে আয়রনের ঘাটতি পূরণ করতে হবে—আয়রন ওষুধ দ্বারা পেটে প্রদাহ হলে, আয়রন হজমজনিত কোনো রোগে আক্রান্ত হলে, শরীর থেকে রক্তপাত, সর্বোপরি শরীরে আয়রনের প্রচুর ঘাটতির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হলে।
রক্তশূন্যতা ছাড়া দেহে আয়রন ঘাটতিতে রক্ত দেওয়ার কোনো নির্দেশনা নেই। বরং তা দেহের জন্য ক্ষতিকর। আয়রন ঘাটতির সঠিক কারণ বের করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে।