প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

চোখের রেটিনায় ছররা গুলির আঘাতের কি চিকিৎসা সম্ভব?

সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববারে পালিত হয় ‘বিশ্ব রেটিনা দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য ‘আপনার রেটিনাকে ভালোবাসুন, আপনার চোখ সুরক্ষিত রাখুন।’

রেটিনা চোখের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাতলা পর্দার মতো অংশ। ১০টি স্তর দিয়ে তৈরি এই অংশ আলোকে নিউরাল সিগন্যালে রূপান্তরিত করে এবং তাকে মস্তিষ্কে দৃষ্টি হিসেবে ব্যাখ্যা করে। এর কাজ অনেকটা ক্যামেরার ফিল্মের মতো। ছবি ধারণ করে অপটিক নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠানো।
সাম্প্রতিক সময়ে রেটিনায় রক্তক্ষরণ ও রেটিনাল ডিটাচমেন্ট নিয়ে অনেক রোগীই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন। ছররা গুলির আঘাতে রেটিনাল ডিটাচমেন্টে ভুগছেন, এমন রোগীর সংখ্যাও কম নয়।
বিশেষ কিছু পরীক্ষা, যেমন সিটি স্ক্যান ও বি স্ক্যানের মাধ্যমে গুলির উপস্থিতি ও অবস্থান নির্ণয় করা যায়। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পরিস্থিতি অনুযায়ী চিকিৎসকেরা সিদ্ধান্তে আসেন। যেমন গুলির প্রবেশপথ যদি চোখের সাদা অংশ দিয়ে হয়ে থাকে, তাহলে রেটিনার সার্জারিও একই সঙ্গে করে ফেলা হয়।

আঘাতের প্রবেশপথ যদি কর্নিয়া দিয়ে হয়, তবে তা লেন্সকেও একই সঙ্গে আঘাত করে। সে ক্ষেত্রে ‘কর্নিয়া রিপেয়ার’, ‘লেন্স এক্সট্রাকশন’ ও একই সঙ্গে অবস্থা বুঝে কৃত্রিম লেন্স সংযোজন ও রেটিনাল ডিটাচমেন্ট সার্জারিরও প্রয়োজন হতে পারে।

গুলিবিদ্ধ চোখের রেটিনা সার্জারি কী

সাধারণত চোখের ভেতরে ছররা গুলি প্রবেশ করা মাত্র আক্রান্ত স্থানে ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রেটিনা ছিঁড়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে গুলি সোজা চোখের মধ্যমণি বরাবর ম্যাকুলায় আঘাত করে, ফলে চোখের দৃষ্টির প্রধান অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেটিনা সার্জারিতে মূলত আমরা চোখের ভিট্রিয়াস জেলি ও একই সঙ্গে জমে থাকা জমাট রক্ত চোখের ভেতর থেকে ভিট্রেকটোমি কাটার দিয়ে বের করে আনি, এরপর ছিঁড়ে যাওয়া রেটিনার অংশ জোড়া লাগানো হয় এবং লেজার করা হয় যা ‘এন্ডেলেজার’ নামে পরিচিত।
পরের ধাপে এয়ারফ্লুইড এক্সচেঞ্জ করা হয় ও সিলিকন অয়েল নামক এক বিশেষ ধরনের অয়েল চোখে প্রবেশ করানো হয়, যাতে চোখের রেটিনা ও চোখের গঠন, কাঠামো স্বাভাবিক থাকে।
এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো ভিট্রিকট্রোমি সার্জারির আগে এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ও বি-স্ক্যান আলট্রাসনোগ্রাম করে ভালোভাবে গুলির অবস্থান নির্ণয় করতে হবে। একমাত্র অবস্থান নির্ণয় করতে পারলেই অস্ত্রোপচারের সময় গুলি বের করে আনা সম্ভব। গুলির আকৃতি সাধারণত ৩ বাই ৩ মিমি। তাই বিশেষ ধরনের ফরসেপের মাধ্যমে চোখের ভেতর থেকে ছররা গুলি বের করতে হয়।

গুলিবিদ্ধ চোখ থেকে কি ছররা গুলি বের করে আনা সম্ভব

এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ও বি স্ক্যান আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা করে আগে বুঝে নিতে হবে, গুলি এখনো চোখের ভিট্রিয়াস ক্যাভিটিতে আছে কি না। ছররা গুলি ভিট্রিয়াস ক্যাভিটিতে থাকলেই কেবল তা বের করে আনা সম্ভব। যদি ভিট্রিয়াস ক্যাভিটি ভেদ করে অপটিক নার্ভ হেডের কাছে চলে যায়, অথবা করোয়েড পর্দা দিয়ে স্ক্লেরায় চলে যায়, অথবা রেট্রো অরবিটাল স্পেসে চলে যায়, তবে তা বের করার চেষ্টা না করাই ভালো। বের করতে গেলে চোখের ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে যায়। আমরা যে সব সার্জারি করেছি, এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে গড়ে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগীর চোখে ছররা গুলির উপস্থিতি পেয়েছি এবং বের করেছি। বাকি ৫০ শতাংশ গুলি ভিট্রিয়াস ক্যাভিটির বাইরে চলে গেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, যেসব ক্ষেত্রে গুলি ভেদ করে বাইরে চলে গেছে, সেগুলোর পোস্ট অপারেটিভ পরিণতি গুলি বের করে নিয়ে আসার চেয়ে কিছুটা ভালো। কারণ, গুলি বের করে আনতে গেলেও চোখের কিছু অংশে ইনজুরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

গুলিবিদ্ধ চোখে ছররা গুলি রয়ে গেলে কি কোনো সমস্যা হবে

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, যেসব ছররা গুলি বের করা সম্ভব হয় না, তা নিয়ে রোগী সব সময়ই দুশ্চিন্তায় ভোগেন, যা খুব স্বাভাবিক।
ভিট্রিয়াস ক্যাভিটি যদি পরিষ্কার থাকে এবং ছররা গুলি যদি রেট্রো অরবিটাল স্পেসে থাকে, তাহলে রয়ে যাওয়া গুলি চোখের বা অন্য কোনো অঙ্গের সমস্যা করবে না। অতএব গুলির ছররা বের করা সম্ভব না হলেও দুশ্চিন্তার কারণ নেই।

গুলিবিদ্ধ চোখ অপারেশনের পর দৃষ্টি কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব

অপারেশন–পরবর্তী দৃষ্টি ফিরে আসা সম্পূর্ণ নির্ভর করে গুলিটি চোখের রেটিনার কোন অংশে আঘাত করেছে, তার ওপর। পেরিফেরাল রেটিনায় আঘাত করলে অপারেশন–পরবর্তী দৃষ্টি ফিরে আসার সম্ভাবনা বেশি। ম্যাকুলা ও অপটিক নার্ভ ইনজুরি হলেও দৃষ্টি ফিরে আসে, তবে ক্ষেত্রবিশেষে এই দৃষ্টিশক্তি খুবই ক্ষীণ হয়ে থাকে।
যেকোনো রেটিনা ইনজুরির ক্ষেত্রেই দ্রুত একজন রেটিনা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে পরীক্ষা–নীরিক্ষার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সহযোগী অধ্যাপক (ভিট্রিও-রেটিনা), চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়