সেলফির সঙ্গে উকুনের কী সম্পর্ক, জানেন?

এখন ডার্মাটোলজিস্টদের কাছে মাথায় উকুনের সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি (প্রতীকী ছবি)
ছবি: পেক্সেলস ডটকম

বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে বিশেষ করে তরুণীদের ভেতর বেড়ে গেছে মাথায় উকুনের সমস্যা। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল একটা অদ্ভুত ব্যাপার। উকুন ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ‘সেলফি’র। মোবাইলের একটা স্ক্রিনে কয়েকজনকে আঁটানোর সুযোগে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ছড়িয়ে পড়ছে উকুন। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, বেশ কয়েকজন ডার্মাটোলজিস্টের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের কাছে মাথায় উকুনের সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা আগের চেয়ে বেশি। সেই সব রোগীর নাম–ঠিকানা নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তাঁদের বেশীরভাগই কম বয়সী তরুণী। আর তাঁদের অনেকেই সেলফি তোলায় ওস্তাদ।

লাইস ক্লিনিকস অব আমেরিকার পরিচালক ক্রিস্তা লওয়ার জানান, মহামারিকালের পর থেকে সারা যুক্তরাষ্ট্রেই ছড়িয়ে পড়েছে উকুনের সমস্যা। তবে এ মুহূর্তে সর্ব্বোচ্চ। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে যুক্তারষ্ট্রে উকুনের সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা ১৮ শতাংশ বেশি। এদিকে বাজারে উকুননাশক শ্যাম্পু ও ওষুধের বিক্রি বেড়েছে ২০ শতাংশ পর্যন্ত। ক্রিস্তা আরও জানান, কানাডার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা ‘ঢের ভালো’। কেননা, কানাডায় ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে উকুনের সমস্যায় ক্লিনিকে যাওয়া রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। যুক্তরাজ্যের চুলের স্বাস্থ্যের জন্য নামকরা ক্লিনিক হেয়ারফোর্সের মালিক ডা. ডি রাইট জানিয়েছেন, তাঁদের দেশেও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে উকুনের সমস্যা।

জেনিফার রোসা একজন উকুনবিশেষজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে তাঁর দুটি ক্লিনিক আছে। রোসা জানান, মানুষ উকুনে আক্রান্ত হয়ে প্রথমেই ক্লিনিকে আসে না। শুরুতে তারা ঘরোয়া পদ্ধতিতে উকুন নির্মূলের চেষ্টা করে। এরপর চেনা পরিচিতদের কাছে বা আগে আক্রান্ত হয়েছে, এমন কারও কাছ থেকে সমাধান নেয়। ইন্টারনেট দেখেও শ্যাম্পু বা ওষুধ কেনে। তারপরও যখন কাজ হয় না, কেবল তখনই তারা ক্লিনিকে আসে।

যুক্তরাজ্য, আর্জেন্টিনা, পোল্যান্ড ও আরও কয়েকটি দেশের জরিপ অনুসারে, স্কুলের বাচ্চাদের ভেতরেও উকুনে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়েছে। মহামারিকালে লম্বা সময় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস–আদালত বন্ধ ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মেলামেশার সুযোগ কম ছিল। তাই সেই সময় মানুষ খুব কমই উকুনের সমস্যায় ভুগেছে। আবার যখন স্কুল খুলে গেছে, তখন স্কুলের বাচ্চাদের ভেতর উকুন ছড়িয়ে পরার হার বেড়ে গেছে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পতঙ্গবিশেষজ্ঞ রিচার্ড পোলাক জানান, বাচ্চাদের মাথায় উকুন ছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গ বাসা বাঁধে। বাইরে খেলাধুলা, খাবার আটকে থাকা, খুশকি, চুলের স্প্রে, জেল—নানা কিছুর মাধ্যমে এসব পতঙ্গ আকৃষ্ট হয়, ছড়ায়।

উকুন থেকে মুক্তির উপায়

আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় উকুনের ‘চিকিৎসা’ হলো মাথা ন্যাড়া করে ফেলা। তবে সেটা তো আর কোনো চিকিৎসা হতে পারে না!

ঘরোয়াভাবে উকুন থেকে মুক্তির জন্য বিশেষ চিরুনি দিয়ে উকুন বের করে মারা হয়। তবে কেবল চিরুনি দিয়ে উকুন বের করে মেরে কোনোভাবেই উকুন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। কেননা, এ পদ্ধতিতে উকুনের সংখ্যা কমানো গেলেও উকুনের ডিমগুলো বিনাশ করা সম্ভব নয়।

উকুন নাশের জনপ্রিয় কয়েকটি ঘরোয়া উপাদান হলো অলিভ ওয়েল, ভিনেগার, চুলের কন্ডিশনারের সঙ্গে বেকিং সোডা মিশিয়ে ব্যবহার করা বা পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করা। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব উপাদানের ভেতর প্রায় কোনোটাই কার্যকর নয়। একমাত্র পেট্রোলিয়াম জেলি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উকুন ও এর ডিম মেরে ফেলতে পারে। তবে এটি প্রয়োগ বেশ ঝক্কির ব্যাপার।

ফার্মাসিস্ট শেরি টরকোস জানান, উকুনকে চিরতরে বিদায় জানাতে আগে এর জীবনচক্র সম্বন্ধে ভালোভাবে জানতে হবে। কেবল উকুন মারলে ডিম থেকে আবার উকুন ফিরে আসবে। আসলে উকুনকে পাকাপাকিভাবে বিদায় জানানো সহজ নয়।

শেরি আরও জানান, যেসব শ্যাম্পু বা কন্ডিশনারে সিলিকন বেজড পলিমার ডাইমেথিকন আছে, সেগুলো উকুন ও এর ডিম মেরে ফেলতে সক্ষম। তবে এতে চুল পড়া বা রুক্ষ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে। লাইস ক্লিনিকস অব আমেরিকায় বিশেষ পদ্ধতিতে চুলের ভেতর দিয়ে গরম বাতাস প্রবাহিত করে উকুন ও এর ডিম মারা হয়। তবে হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করে ঘরে এটা করা যাবে না। এতে মাথার ত্বক পুড়ে যেতে পারে বা চুলের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

উকুন প্রতিরোধের জন্য বাচ্চাদের ‘হেড টু হেড কনট্যাক্ট’ এড়িয়ে চলতে হবে। যাঁদের লম্বা চুল, তাঁরা পনিটেইল, বেণি বা চুল শক্ত করে বেঁধে বাইরে বের হবেন।

উকুন কেবল ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয় নয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও সচেতনতার বিকল্প নেই। সেলফি তোলার সময় মাথার সঙ্গে যাতে মাথা না লাগে, সেটি খেয়াল রাখবেন। উকুন নির্মূলের জন্য পরিবারের সবাইকে (একাধিক ব্যক্তি আক্রান্ত হলে) একসঙ্গে চিকিৎসা নিতে হবে।


সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট