মন বিক্ষিপ্ত হলে একটু থেমে মস্তিষ্কের সমস্যা সমাধানকারী অংশকে সক্রিয় হওয়ার জন্য সময় দিন। মডেল: সাবরিন
মন বিক্ষিপ্ত হলে একটু থেমে মস্তিষ্কের সমস্যা সমাধানকারী অংশকে সক্রিয় হওয়ার জন্য সময় দিন। মডেল: সাবরিন

মন শান্ত রাখার ৩টি ধাপ

জীবনে চলার পথে আমরা নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হই। মানসিক চাপ বোধ করি। এই মানসিক চাপ তীব্র হলে আমাদের মধ্যে একধরনের অতি-উত্তেজনা কাজ করে, ফলে দৈনন্দিন কাজে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এই সময়টিতে সাধারণত মস্তিষ্কের যৌক্তিক অঞ্চল নিষ্ক্রিয় থাকে। আমরা মস্তিষ্কের আবেগীয় অঞ্চল দ্বারা তাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি (বা আচরণ করি), যা আমাদের বিপদ ও ভোগান্তির মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। কেউ কেউ আবার এমন সময়ে বোধশক্তিহীন হয়ে যান। কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। অতি-উত্তেজনা বা বোধশক্তিহীনতা থেকে স্বাভাবিক মাত্রার উত্তেজনায় ফিরে আসা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা দীর্ঘ সময় আমরা এই অতি-উত্তেজনা বা বোধশক্তিহীনতার মধ্যে থাকলে তা মানসিক রোগে রূপ নিতে পারে।

অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে অশান্ত মনকে শান্ত করে জীবন ও কাজের স্বাভাবিক গতিতে ফেরার একটি অন্যতম উপায় হলো আত্মমমতার চর্চা (সেলফ কম্প্যাশন)। অর্থাৎ কঠিন সময়ে বন্ধু হয়ে নিজের পাশে থাকা, নিজেকে মমতায় ভরিয়ে তোলা। তিনটি ধাপে খুব সহজে এই চর্চা করা যায়।

১. একটু থামি: কিছু ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই সাময়িক উত্তেজনায় কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকব। অনুভূতি খেয়াল করব। শরীরের কোথায় কেমন লাগছে, খেয়াল করব। যেমন বুক ধড়ফড় করছে কি না; হাত–পা কাঁপছে কি না; মাথা, ঘাড় বা শরীরের আর কোথাও কোনো অস্বস্তি হচ্ছে কি না, গভীর মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করব। সাময়িক এই বিরতির মূল উদ্দেশ্য হলো মস্তিষ্কের যৌক্তিক ও সমস্যা সমাধানকারী অংশকে সক্রিয় হওয়ার জন্য সময় দেওয়া।

যোগব্যায়ামের মাধ্যমে মন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। মডেল: হানি

২. অক্সিজেন ও পানি: কোনো কিছু ঘটার পর আমরা যখন অস্থির বা নিস্তেজ বোধ করি, তখন আমাদের শরীরে অক্সিজেন ও পানির স্বল্পতা সৃষ্টি হয়। এসব মুহূর্তে তাই অনেকেরই ঠোঁট ও গলা শুকিয়ে যায়, দমবন্ধ বোধ হয়। এ সময় পানি পান করে এবং গভীরভাবে অন্তত তিন-পাঁচ জোড়া শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে শরীরে অক্সিজেন ও পানির ঘাটতি পূরণ করা যায়। নাক দিয়ে ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিতে হবে এবং ছাড়ার সময় মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়তে হবে। গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অসুবিধা হলে শুধু শ্বাস–প্রশ্বাসে মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে। এটিকে বলা হয় মাইন্ডফুল ব্রিদিং। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় নাকের ডগায় কেমন অনুভূতি হচ্ছে সূক্ষ্মভাবে তা খেয়াল করা। তিন-পাঁচ জোড়া বা প্রয়োজনে আরও বেশি সময় ধরে শুধুই শ্বাস-প্রশ্বাস খেয়াল করতে হবে। এভাবে শরীরে পানি ও অক্সিজেন সরবরাহ করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীর ও মন দুটোই শান্ত হয়ে যাবে।

৩. মমতা মাখানো কিছু কথা: যেকোনো পরিস্থিতিতে আমরা কেমন বোধ করব, তা অনেকাংশে নির্ভর করে আমরা মনে মনে নিজেকে কী বলছি, কীভাবে বলছি তার ওপর। কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য প্রস্তুত করতে, নিজের প্রতি আমাদের সদয় হওয়া প্রয়োজন। নিজেকে মমতামাখানো কিছু কথা বলা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মনোবিজ্ঞানী ক্রিস্টিন নেফ তার একাধিক গবেষণায় দেখেছেন, কঠিন পরিস্থিতিতে নিজের যত্ন নিয়ে, নিজের প্রতি সদয় থেকে, (নিজেকে) মমতাপূর্ণ কিছু কথা বললে সহজেই নিজের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা যায়। আর সেই সঙ্গে সমস্যা সমাধানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা সহজ যায়।

মনের শান্তির জন্য নিজেকে সময় দিন। মডেল: তানহা।

অর্থাৎ যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে কিছুটা পানি পান করে নেওয়া, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে অক্সিজেন নেওয়া, তারপর নিজেকে বলা:

এই মুহূর্তটি কষ্টের, মানসিক চাপের।

নিজেকে শান্ত রাখতে যে মমতা আমার দরকার

তা আমি নিজেকে দিতে পারি।

কঠিন সময়ে আমি নিজের সঙ্গে থাকতে পারি।

দুঃখ–কষ্ট আমাদের জীবনেরই অংশ,

আমি একা নই, জীবনে আমরা সবাই যুদ্ধ করি।

আমি ধৈর্য ধারণ করতে পারি,

আমি শান্ত হতে পারি,

আমি শক্তিশালী হতে পারি।

যে কঠিন সময় ও অনুভূতির মধ্য দিয়ে আমি যাচ্ছি

তা আমি অতিক্রম করতে যাচ্ছি,

আমি নিজের সঙ্গে আছি!

এ ছাড়াও কঠিন সময়ে নিজেকে শান্ত করতে আমরা পছন্দের কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। কেউ হয়তো গান শুনতে ভালোবাসেন, কেউ ভালোবাসেন বাগান পরিচর্যা করতে সেই কাজটাই করুন এই সময়ে। হাঁটতে বা ঘুরতে বের হওয়া, পছন্দের খাবার খাওয়া, কাছের মানুষের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা, তাকে জড়িয়ে ধরার মতো কাজগুলো করলেও মানসিক প্রশান্তি মেলে।

লেখক: কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ও সহকারী অধ্যাপক, এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।