একজন ডায়াবেটিসের রোগীর জীবনে যেকোনো মুহূর্তে ইনসুলিন চিকিৎসার প্রয়োজন পড়তে পারে। কিন্তু ইনসুলিনের কথা শুনলেই বেশির ভাগ ডায়াবেটিকই ঘাবড়ে যান, মুষড়ে পড়েন। তাঁদের ধারণা, ইনসুলিন হচ্ছে ডায়াবেটিসের শেষ চিকিৎসা কিংবা ডায়াবেটিসের সবচেয়ে জটিল ধাপে পৌঁছে গেছেন তিনি। কিন্তু এই ধারণা অমূলক।
প্রথমে দেখা যাক, কোন ধরনের ডায়াবেটিসে ওষুধ দ্বারা চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই, শুরু থেকেই ইনসুলিন অপরিহার্য। এর মধ্যে পড়ে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের রোগী, যাঁদের ছোটবেলায় অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী বিটা কোষ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। সে কারণে ইনসুলিনই তাঁদের জন্য একমাত্র চিকিৎসা। এরপরই আসে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এবং স্তন্যদানকারী মায়ের ডায়াবেটিস। এ সময় ইনসুলিন ছাড়া অন্যান্য ওষুধ শিশুর জন্য নিরাপদ নয়। কারও যদি বড় ধরনের সার্জারি দরকার হয়, জটিল কোনো রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় (যেমন নিউমোনিয়া, কোভিড–১৯, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, সেপসিস ইত্যাদি), কিডনি ও যকৃতের জটিল সমস্যা থাকে, রক্তের শর্করা অত্যধিক বেড়ে গিয়ে কিটোঅ্যাসিডোসিস বা হাইপারঅসমোলার কোমার মতো সংকটাপন্ন অবস্থা দেখা দেয়, দুর্ঘটনা বা ঘা দ্রুত শুকানোর প্রয়োজন পড়ে, তাহলে সাময়িকভাবে ইনসুলিন দরকার হবে। না হলে রোগীর অবস্থা আরও জটিল হবে। সুস্থ হওয়ার পর তাঁদের অনেকেরই আবার ওষুধে ফিরে যাওয়া সম্ভব।
আরেক ধরনের রোগী আছেন, শুরুতেই যাঁদের রক্তে শর্করা খালি পেটে ১৬ মিলি মোলের ওপর এবং গড় শর্করা এইচবিএওয়ানসি ১০ শতাংশের ওপর। এসব ক্ষেত্রে ওষুধ না দিয়ে ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা করে প্রথমে শর্করা কমিয়ে আনতে হবে। কারও যদি তিন বা ততোধিক ধরনের মুখে খাবার ওষুধ উচ্চমাত্রায় সেবন করার পরও রক্তে শর্করা অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তবে তাঁকেও ইনসুলিন নিতে হবে।
ডায়াবেটিসের সব ধরনের চিকিৎসার মধ্যে ইনসুলিন সবচেয়ে নিরাপদ। কারণ, এর তেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। কিডনি বা যকৃৎ অকৃতকার্যতার রোগী, হৃদ্যন্ত্র অকৃতকার্যতা বা হাসপাতালে সংকটাপন্ন রোগীর জন্যও ইনসুলিনই নিরাপদ ভরসা। ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে তাই ইনসুলিনের বিকল্প নেই।
ইনসুলিনের প্রধানতম দুটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো—ওজন বৃদ্ধি ও হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা হঠাৎ শর্করা কমে যাওয়া। নতুন ধরনের স্মার্ট ইনসুলিনে এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অনেক কম। হাইপোগ্লাইসেমিয়া মুখে খাওয়ার কিছু ওষুধেও হয়ে থাকে। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হলো সঠিক সময়ে খাওয়া ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করা। ইনসুলিন গ্রহণকারী রোগীরা অন্যদের তুলনায় বেশি সুশৃঙ্খল ও সচেতন হয়ে থাকেন।
আধুনিক ইনসুলিন ডিভাইস প্রায় ব্যথামুক্তও বটে। হালের ইনুসলিনে ইনজেকশন দেওয়ার পর আধঘণ্টা অপেক্ষা করারও প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি ভুলে গেলে খাবার পরও দেওয়া যায়।
কখনো স্থায়ীভাবে, কখনো সাময়িক—আপনার চিকিৎসক আপনার ভালোর জন্যই ইনসুলিন ব্যবস্থাপত্রে দিতে পারেন। এর মানে এই নয় যে আপনার জীবনের সব আশা–ভরসা শেষ। কোনো বিশেষ কারণে ইনসুলিন নিতে হলে সারা জীবন নিতে হবে, এমনটাও সব সময় সত্যি নয়। আবার যদি সারা জীবন নিতেও হয় সেটি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা। বরং রক্তে শর্করা অনিয়ন্ত্রিত থাকলে হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, কিডনি অকার্যকর, দৃষ্টিহীনতাসহ নানা জটিলতা দেখা দেবে। তাই রোগকে ভয় পাবেন, চিকিৎসাকে নয়।