খেজুরের কাঁচা রস পানে তো বিপদ আছেই, আরও যেভাবে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন

দেশে এ পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ৩২৬ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে মারা গেছে ২৩১ জন

কাঁচা খেজুরের রস পান করে অনেকে নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন

খবরে জানলাম, নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণে সম্প্রতি রাজশাহীতে ৩৫ বছরের এক নারী মারা গেছেন। কাঁচা খেজুরের রস খেয়ে সংক্রমিত হয়েছিলেন তিনি। শুধু এই একটি ঘটনা নয়, প্রতিবছর শীতের সময় নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়।

নিপাহ ভাইরাস নামটি যে গ্রামের নামে

১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ায় প্রথম নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। সংক্রমণের উৎস ছিল নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত অসুস্থ শূকর। মালয়েশিয়ার ‘সুঙ্গাই নিপাহ’ নামের একটি গ্রামের নামে এই ভাইরাসের নাম করা হয়। রোগটি যেন মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য সে সময় লাখ লাখ শূকর মেরে ফেলা হয়। কারণ, আক্রান্ত শূকর থেকে ভাইরাসটি বাড়ির পোষা কুকুর-বিড়াল, ঘোড়া, ছাগলের দেহেও ছড়িয়ে পড়েছিল।

নিপাহ ভাইরাসে সে সময় মালয়েশিয়ায় ২৫৬ জন ‘নিপাহ এনকেফেলাইটিস’ বা মস্তিষ্কের প্রদাহ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, যার মধ্যে ১০৫ জনই মারা যায়। বাংলাদেশের মেহেরপুরে ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে ২০০১ সালে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর শীতকালে বাংলাদেশের উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো, বিশেষ করে মেহেরপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল, পাবনা, নাটোর, মানিকগঞ্জ, গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, মাদারীপুর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। দেশে এ পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ৩২৬ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে মারা গেছে ২৩১ জন।

নিপাহ ভাইরাস বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়ে থাকে

যেভাবে ছড়ায়

নিপাহ ভাইরাস প্রাণী থেকে বিশেষ করে বাদুড় ও শূকর থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়ে থাকে। আক্রান্ত বাদুড় কোনো ফল খেলে বা খেজুরের রস পান করলে এটির লালা, প্রস্রাব বা অন্যান্য বর্জ্য দিয়ে সরাসরি সেই ফল বা খেজুরের রস দূষিত হয়ে যায়। কোনো মানুষ যদি সেই ফল খায় বা কাঁচা খেজুরের রস পান করে, তাহলে সে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। এ ছাড়া আক্রান্ত মানুষের সরাসরি সংস্পর্শে থেকেও আরেকজন সংক্রমিত হতে পারে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এতে মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

লক্ষণ ও উপসর্গ

সাধারণত সংক্রমণের ৫–১৪ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। তবে লক্ষণ প্রকাশ না করেও ৪৫ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় শরীরের মধ্যে থাকতে পারে। প্রাথমিকভাবে প্রচণ্ড জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, বমি, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা যায়। মাথা ঘোরা, ঘন ঘন তৃষ্ণা পাওয়া, ঘুম ঘুম ভাব, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, প্রলাপ বকা ও মস্তিষ্কের তীব্র সংক্রমণজনিত নানাবিধ স্নায়বিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কেউ কেউ নিউমোনিয়া, রক্ত জমাট বাঁধা, বুকে তীব্র যন্ত্রণাসহ তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে আসে। তাদের দ্বারা এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও বেশি থাকে। এ ক্ষেত্রে অনেকে প্রাথমিকভাবে ভালো হয়ে উঠলেও পরে মস্তিষ্কের বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার কয়েক বছর পরও তার শরীরে পুনরায় নিপাহ ভাইরাস সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে, যাকে ‘রিল্যাপসিং এনকেফেলাইটিস’ বলা হয়।

রোগনির্ণয়

নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের প্রাথমিক লক্ষণগুলো অন্যান্য ভাইরাসের মতোই। সঠিক সময়ে রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় সমস্যা। প্রস্রাব, রক্ত, সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড ইত্যাদি শারীরিক তরল থেকে পিসিআর, অ্যান্টিবডি টেস্ট, এলাইজা, সেল কালচার দ্বারা ভাইরাসটিকে শনাক্ত করা যায়। রোগ থেকে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর অ্যান্টিবডি শনাক্ত করে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত করা যায়, যা পরবর্তী সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।

চিকিৎসা

নিপাহ ভাইরাসে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে বা আক্রান্ত হয়েছে সন্দেহ হলে তাকে আলাদা করে রাখতে হবে। এরপর দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই, টিকাও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এটি যেহেতু একটি এনভেলপড ভাইরাস, তাই সাবান, ডিটারজেন্ট, ৭০ শতাংশ অ্যালকোহল এবং ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রার মাধ্যমে এই ভাইরাস ধ্বংস করা সম্ভব।

প্রতিরোধ

নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের কোনো কার্যকর চিকিৎসা না থাকায় সঠিক রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • কাঁচা খেজুরের রস পান থেকে বিরত থাকুন।

  • যেকোনো ফল খাওয়ার আগে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।

  • বাদুড় বা অন্য কোনো পাখির আংশিক খাওয়া ফল খাবেন না।

  • নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি বা রুগ্‌ণ পশু থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।

  • প্রাণী বিশেষ করে শূকরের খামারে কাজ করার সময় সতর্ক থাকুন।

  • আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক-নার্সদের বিশেষ সতর্কতা, যেমন মুখে মাস্ক-গ্লাভস-গাউন ব্যবহার, রোগী দেখার পর হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধোয়া ইত্যাদি অবলম্বন করা উচিত।

  • রোগীর ব্যবহার করা কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী সাবান দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করুন।

  • নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর কফ ও থুতু যেখানে-সেখানে না ফেলে একটি পাত্রে রেখে পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

*ডা. কাকলী হালদার: সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ