কিডনি আমাদের দেহের ক্ষতিকর দূষিত পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। কিডনি বিকল হলে তাই নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে বিশ্বের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। অনেকের ধারণা কেবল বয়স্কদের কিডনি রোগ হয়। কিন্তু শিশুরাও কিডনি সমস্যায় ভোগে। শিশুদের কিডনি রোগের চিকিৎসা বয়স্কদের কিডনি রোগের চিকিৎসা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে আমাদের দেশে হাসপাতালে আসা শিশুদের মধ্যে প্রতি ২০ জনে ১ জন কিডনি রোগে আক্রান্ত। শিশুদের কিডনি রোগের এক বড় অংশ জন্মগত কিডনি রোগ। সঠিক চিকিৎসার অভাবে এতে কিডনি বিকলও হয়ে যেতে পারে।
লক্ষণ কী
জন্মগত কিডনি রোগ
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জন্মগত কিডনি রোগ মায়ের গর্ভে থাকাকালে আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়। যেমন কিডনি অথবা প্রস্রাবের নালি ফুলে যাওয়া, একটি বা উভয় কিডনিতে এক বা একাধিক সিস্ট থাকা। মায়ের গর্ভের পানি কম বা বেশি হওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া নবজাতক ও শিশুদের ঘন ঘন প্রস্রাব, ফোঁটায় ফোঁটায় প্রস্রাব হওয়া, ছেলেদের প্রস্রাব দূরে না যাওয়া, প্রস্রাব করা শেষ হওয়ার পরও ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব পড়তে থাকা, পেটের নিচের অংশে ফোলা বা কোনো চাকা অনুভূত হওয়া এবং ঘন ঘন জ্বর হওয়া।
জন্মের পরে কিডনি রোগ
১) প্রস্রাব করার সময় ব্যথা হওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া অথবা ফেনা ফেনা প্রস্রাব হওয়া।
২) সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মুখ ফুলে যাওয়া, পা ফুলে যাওয়া, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাল চাকা চাকা দাগ হওয়া।
৩) শারীরিক দুর্বল ভাব, ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অল্প পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া, বয়সের তুলনায় শিশুর বিকাশ কম হওয়া অথবা কম বয়সে উচ্চ রক্তচাপ।
৪) স্বাভাবিকের তুলনায় কম বা বেশি প্রস্রাব করা এবং পাঁচ বছর বয়সের পরও বিছানায় প্রস্রাব করা।
কিডনি ফেইলিওর বা কিডনি বিকল হলে কী হয়
কিডনি ফেইলিওর সাধারণত দুই ধরনের—
অ্যাকিউট বা আকস্মিক কিডনি ফেইলিওর
ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি কিডনি ফেইলিওর
শিশুদের অ্যাকিউট বা আকস্মিক কিডনি ফেইলিওরের কারণ
১) অতিরিক্ত রক্তপাত, বড় অপারেশন, ডায়রিয়া বা দীর্ঘক্ষণ বমি হওয়া।
২) রক্তের সংক্রমণ বা অন্যান্য কারণে কিডনিতে অক্সিজেন ও রক্ত পৌঁছাতে না পারলে।
৩) কিছু ওষুধ আছে, যা খেলে পরে কিডনি সমস্যা হতে পারে।
৪) হেমোলিটিক ইউরেমিক সিনড্রোম আক্রান্ত শিশুরা।
শিশুদের ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি কিডনি ফেইলিওরের কারণ
১) বারবার মূত্রনালির সংক্রমণ বা দীর্ঘদিন মূত্রনালিতে বাধার ফলে প্রস্রাব পরিষ্কার না হলে।
২) প্রস্রাবে প্রোটিন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকলে।
৩) পূর্বে অ্যাকিউট কিডনি বিকল বা অকার্যকর হলে এবং তা সঠিক নিয়মে ফলোআপ না করালে।
৪) কেউ উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসে ভুগলে এবং তার সঠিক চিকিৎসা না করালে।
৫) জিনগত বা বংশগত কিডনি রোগ থাকলে।
রোগ নির্ণয়
শিশুদের কিডনি রোগ শনাক্ত এবং যথাযথ চিকিৎসার জন্য দক্ষ শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ বা পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজিস্টের পরামর্শ প্রয়োজন। অভিজ্ঞ পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজিস্টের নির্দেশনা অনুযায়ী রক্ত, প্রস্রাব ও আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনি রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।
চিকিৎসা
কিডনি রোগ কোন পর্যায়ে আছে বা কী কারণে হয়েছে, তার ওপর চিকিৎসা নির্ভর করে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে দ্রুত রোগনির্ণয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জন্মগত কিডনি রোগের চিকিৎসায় কিছু ক্ষেত্রে অপারেশন প্রয়োজন হয়, তবে এদের মধ্যে বেশির ভাগ শিশুই বারবার প্রস্রাবের সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে, তাই তাদের ক্ষেত্রে লম্বা সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হয়।
ডায়রিয়ার কারণে কিডনি সমস্যা হলে, প্রয়োজনমতো পানিশূন্যতা এবং রক্তের লবণের তারতম্য ঠিক করা হয়। ক্রনিক কিডনি ফেইলিওর প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে ওষুধের সাহায্যে ও জীবনযাত্রা পরিবর্তন বা নিয়ন্ত্রণ করে বেশ উপকার পাওয়া যায়। তবে শেষ পর্যায়ে ধরা পড়লে ডায়ালাইসিস ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন হয়।
ডায়ালাইসিস
ডায়ালাইসিস কিডনি ফেইলিওর রোগের একধরনের চিকিৎসা। যখন কিডনির কার্যক্ষমতা প্রায় ১০ ভাগের নিচে নেমে আসে, তখন ডায়ালাইসিস শুরু করা হয় এবং ডায়ালাইসিসের দ্বারা কিডনির কাজ সাময়িকভাবে চালানো হয়। শিশুদের ডায়ালাইসিস বড়দের থেকে ভিন্ন এবং এতে অধিকতর সতর্কতার প্রয়োজন হয়।
কীভাবে আপনার শিশুর কিডনির যত্ন নেবেন?
শিশুকে পরিমিত পরিমাণ পানি খাওয়ান, বিশেষ করে ডায়রিয়া বা জ্বর হলে বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়ান। শিশুর যেন নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস তৈরি হয়। বাচ্চার যদি কোনো কিডনি রোগ থাকে অথবা বংশে কারও কিডনি রোগ থাকলে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। শিশুর খাদ্যতালিকায় প্যাকেটজাত খাবার ও পানীয় নিয়ন্ত্রণ করুন। ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
ডা. মো. আব্দুল কাদের, অ্যাসোসিয়েট কনসালট্যান্ট, স্কয়ার চিলড্রেন কিডনি ও ডায়ালাইসিস সেন্টার, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড, পান্থপথ, ঢাকা।