থাইরয়েডের নানা রকম সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরয়েড হরমোন ঘাটতিজনিত রোগ। থাইরয়েড–সংক্রান্ত রোগ ব্যাধিগুলোর মধ্যে এই রোগে সর্বাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকেন। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এ রোগের আধিক্য বেশি। পুরুষ ও নারীদের প্রজননস্বাস্থ্যে থাইরয়েড হরমোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে হরমোনটির তারতম্যের কারণে বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত হতে পারে। গর্ভকালীন মা ও গর্ভস্থ শিশুর নানাবিধ জটিলতা দেখা দিতে পারে। যাঁদের থাইরয়েডের সমস্যা আছে, তাঁরা একটা উদ্বেগের মধ্যে থাকেন, তাঁরা মা হতে পারবেন কিনা। অবশ্যই পারবেন, তবে তাঁর জন্য চাই সচেতনতা।
গর্ভের প্রথম ধাপে গর্ভস্থ ভ্রূণের বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য নিজস্ব কোনো থাইরয়েড হরমোন থাকে না। এটির জন্য মায়ের ওপর গর্ভস্থ শিশুটি নির্ভরশীল। মায়ের হরমোন ঘাটতি তাই শিশুর স্নায়বিক বৃদ্ধি ও বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশু হতে পারে বুদ্ধি বৈকল্যের শিকার। অনেক ক্ষেত্রে এর ঘাটতির কারণে গর্ভপাত হতে পারে। এ ছাড়া অকাল প্রসব, চব্বিশ সপ্তাহ পর গর্ভের ভেতর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এসব বাচ্চারা সাধারণত জন্মগতভাবে কম ওজনের হয়ে থাকে। কখনো গর্ভস্থ শিশু হতে পারে জন্মগত হাইপোথাইরয়েডিজম আক্রান্ত।
গর্ভবতী মায়েরাও এই হরমোনের অভাবে অনেক জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারেন। গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তশূন্যতা—তাঁদের অনেক বেশি হয়ে থাকে। মাংসপেশির দুর্বলতা, ব্যথা–বেদনা তাঁদের বেশি হয়। এমনকি হৃৎপিণ্ড বিকল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। তাঁদের গর্ভ ফুল আলাদা হতে পারে গর্ভাশয় থেকে। শুরু হতে পারে রক্তপাত।
গর্ভকালে হাইপোথাইরয়েডিজমের অন্যতম প্রধান কারণ হলো আয়োডিনের ঘাটতি। যে অঞ্চলের মাটি ও শস্যদানায় আয়োডিনের ঘাটতি রয়েছে, সেখানকার মায়েরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো অটোইমিউন থাইরয়েড রোগ। গর্ভের আগেই যাঁদের কিঞ্চিৎ হরমোনের ঘাটতি থাকে, গর্ভকালে তা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। গর্ভের আগেই থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা জেনে নেওয়া জরুরি, বিশেষ করে যেসব মা আয়োডিন ঘাটতিজনিত অঞ্চলের বাসিন্দা, যাঁদের পরিবারে থাইরয়েডের ব্যাধি রয়েছে, কিংবা আগে থেকেই যাঁরা এই রোগে আক্রান্ত। এ ছাড়া যাঁদের বয়স ত্রিশের বেশি, যাঁদের আগে থেকেই গলগণ্ড রয়েছে, যাঁদের অন্য কোনো অটোইমিউন রোগ ব্যাধির নজির রয়েছে কিংবা থাইরয়েড অ্যান্টিবডির উপস্থিতি বিদ্যমান, তাঁরা অবশ্যই হরমোনের মাত্রা জেনে নেবেন। টাইপ–১ ডায়াবেটিস, অতিমাত্রায় স্থূল নারীরা গর্ভের আগে থাইরয়েড সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন। যাঁরা এমায়োডেরন, লিথিয়াম ওষুধ গ্রহণ করছেন কিংবা কোনো কারণে যাঁরা ঘাড়ে কিংবা মাথায় রেডিও থেরাপি ব্যবহার করেছেন কিংবা যাঁদের আগে থাইরয়েডের শল্যচিকিৎসা হয়েছে, তাঁরাও জেনে নেবেন এই হরমোনের মাত্রা কেমন।
থাইরয়েড হরমোন কমে গেলে বেশ কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। ওজন বৃদ্ধি, ক্লান্তি, কোষ্ঠকাঠিন্য, ঠান্ডা অনুভব, অবসন্নতা, শুষ্ক ত্বক-চুল এগুলো হাইপোথাইরয়েডিজমের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। এই লক্ষণগুলো গর্ভকালীন সাধারণ লক্ষণের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়। এ কারণেই অনেকেই বুঝতে পারেন না যে তাঁরা হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত।
থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে মূলত দুটি হরমোন নিঃসরণ হয়। টি৩ ও টি৪। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মস্তিষ্ক থেকে অন্য আরেকটি হরমোন নিঃসরণ হয়, যার নাম টিএসএইচ। রক্তে হরমোন দুটি কমে গেলে টিএসএইচ বেড়ে যায়। রক্তে এটির মাত্রা পর্যবেক্ষণ করে থাইরয়েডের কার্যকারিতা বোঝা যায়। কারও কারও প্রকট হাইপোথাইরয়েডিজম থাকে আবার কারও ক্ষেত্রবিশেষে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। গর্ভকালীন দুটি অবস্থারই চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। গর্ভকালে হাইপোথাইরয়েডিজমের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওষুধের মাত্রা বাড়াতে হয়। অন্য সময়ের তুলনায় টিএসএইচের মান আরও কমের দিকে রাখতে হয় ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে। এ সময় হরমোনের মাত্রা নানাবিধ কারণে খুব বেশি ওঠানামা করে। সে কারণে গর্ভকালে ওষুধের মাত্রা ঠিক করার জন্য হরমোনের মাত্রা দু–এক মাস পরপরই দেখে নিতে হয়। এ ছাড়া যাঁদের রক্তে থাইরয়েড অ্যান্টিবডির উপস্থিতি রয়েছে, তাঁদের আরও সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। কেননা, তাঁদের গর্ভকালীন জটিলতা অন্যদের থেকে বেশি হতে পারে।
সন্তান প্রসবের পর মায়েদের থাইরয়েড ওষুধের মাত্রা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কমাতে হয়। প্রসবের চার সপ্তাহের মধ্যে আবার হরমোন পরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র নেওয়া দরকার। সন্তান প্রসবের পর ক্ষেত্রবিশেষে থাইরয়েড হরমোন সাময়িক সময় বেড়ে যেতে পারে। এমনকি এ সময় কারও কারও অটোইমিউন থাইরয়েডের রোগ প্রকট হতে পারে। এমনকি কারও হাইপোথাইরয়েডিজম স্থায়ী রূপ নিতে পারে। সন্তান প্রসবের পর এ জন্য কমপক্ষে ছয় মাস এই হরমোন পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। সঙ্গে নবজাতকেরও থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা করতে হবে।
লেখক: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সিএমএইচ
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন: