শিশুটি আর আগের মতো খেলাধুলা করছে না, কেমন যেন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত ঘ্যানঘ্যান বা খিটখিটে আচরণ করছে। একটু ফ্যাকাসেও দেখাচ্ছে। এমন হলে অনেক সময় পরীক্ষা করলে দেখা যায়, শিশুটি আসলে রক্তশূন্যতায় ভুগছে। রক্তশূন্যতা কেবল বড়দের নয়, শিশুদেরও হতে পারে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এর কারণ ও চিকিৎসা ভিন্ন হয়ে থাকে।
অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা মানে রক্ত কমে যাওয়া নয়; বরং বয়স ও লিঙ্গভেদে রক্তের লোহিত কণিকায় উপস্থিত হিমোগ্লোবিন কাঙ্ক্ষিত পরিমাণের চেয়ে কমে যাওয়াকে অ্যানিমিয়া বলা হয়। রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত হওয়া মানে শিশুর শরীরের অঙ্গগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত পাচ্ছে না
শিশুর রক্তস্বল্পতা প্রধান কারণ তিনটি—
প্রয়োজনমতো লোহিত রক্তকণিকা উৎপন্ন না হওয়া
লোহিতকণিকা যদি ভেঙে যায়
রক্তপাতসংক্রান্ত কারণ
নবজাতক অবস্থায় শিশু উচ্চ মাত্রার হিমোগ্লোবিন নিয়ে জন্ম নেয়। তবে ধীরে ধীরে দুই মাস বয়সের দিকে তা কমে যেতে থাকে। এটা শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ সময় মায়ের বুকের দুধই যথেষ্ট। প্রয়োজনমতো লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হতে দরকার আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন বি১২। শিশুর খাদ্যে এসবের অভাব থাকলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।
লোহিত রক্তকণিকা যখন ভেঙে যায়, তখন তাকে হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া বলা হয়। নানারকম রোগের কারণে এ ধরনের রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো থ্যালাসেমিয়া।
এ ছাড়া রক্তপাতের কারণেও শিশুদের রক্তশূন্যতা হতে পারে। এর কারণের মধ্যে রয়েছে অন্ত্রে কৃমির সংক্রমণ, হিমোফিলিয়া ইত্যাদি।
মোটাদাগে যেসব কারণে আমাদের দেশের শিশুরা বেশি রক্তশূন্যতায় ভোগে, সেসব হলো—
আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতা
থ্যালাসেমিয়া
অ্যাপ্লাসটিক অ্যানিমিয়া
ক্রনিক রেনাল ফেইলিউর
একিউট লিউকেমিয়া
এর মধ্যে আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতায় আমাদের দেশের শিশুরা বেশি ভুগে থাকে। এক বছর বয়স থেকে বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত সাধারণভাবে শিশুর হিমোগ্লোবিন প্রতি ডেসিলিটারে ১১ গ্রামের কম থাকা মানে শিশু রক্তশূন্যতায় ভুগছে।
শৈশবে আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতার প্রধান কারণ—
অপরিণতভাবে জন্ম নেওয়া—লো বার্থওয়েট (জন্ম সময়ের ওজন ২৫০০ গ্রাম বা তার নিচে)
গরুর দুধ পান করা
বক্র কৃমির সংক্রমণ
দীর্ঘদিন ধরে শুধু বুকের দুধ চালিয়ে যাওয়া
ছয় মাস বয়স থেকে শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার না খাওয়ানো
অপুষ্টি
রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত শিশুর ত্বক, ঠোঁট, হাত-পায়ের তালুতে ফ্যাকাশে ভাব, খিটখিটে মেজাজ, অতিশয় ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড় করা লক্ষণ নিয়ে আসতে পারে। অমনোযোগিতা ও শিশুর দৈহিক বৃদ্ধিতে সমস্যা নিয়েও মা–বাবা অভিযোগ করতে পারেন। কারও কারও ক্ষেত্রে জন্ডিস, কালো রঙের প্রস্রাব, একটুতেই রক্তপাত সমস্যা, পেট ধীরে ধীরে ফুলে যাওয়া, লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া, সারা গায়ে লালচে দাগ এসব সমস্যাও হতে পারে।
শিশুর রক্তশূন্যতা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সঠিক কারণ অনুসন্ধানের জন্য রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে ইলেক্ট্রোফোরেসিস, বোন ম্যারোসহ অনেক পরীক্ষা করানো লাগতে পারে।
রক্তশূন্যতার কারণ ও তীব্রতা অনুযায়ী চিকিৎসার রকমফের ঘটে। তবে আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন সেবন করাতে হবে। শিশু যাতে সবুজ শাকসবজি, কলিজা ও ফল খায়, সে অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুকে শুধু বুকের দুধ দিতে হবে, শিশুকে নিয়মিতভাবে কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। এ ছাড়া বাচ্চাদের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।