আপনি কি আপেলের মতো, নাকি নাশপাতির মতো?

শরীরে চর্বি জমে যাওয়ার ধরনের ওপর ভিত্তি করে দেহের আকৃতিকে বলা যায় আপেলের মতো কিংবা নাশপাতির মতো
ছবি: সংগৃহীত

স্থূলতা বা ওবেসিটি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম স্বাস্থ্যসমস্যা। এটি শুধু ধনী বিশ্বের রোগ নয়, এই সমস্যা স্বল্পোন্নত দেশেও বাড়ছে। স্থূলতা অনেক রোগব্যাধিকে আমন্ত্রণ করে ডেকে আনে।

কীভাবে বুঝবেন আপনি স্থূল?

স্থূলতা নিরূপণের মাপকাঠি হলো বিএমআই বা বডি মাস ইনডেক্স। ওজন আর উচ্চতা জানা থাকলে আপনি নিজেই নির্ণয় করতে পারবেন বিএমআই। ওজন নিতে হবে কেজিতে আর উচ্চতা মিটারে। মিটারের বর্গ দিয়ে কেজিকে ভাগ দিলেই বেরিয়ে আসবে স্থূলতা। যদি বিএমআই ২৩-এর বেশি হয়, তবে বুঝতে হবে, আপনি অধিক ওজনধারী। আর ২৮ কিংবা তার ওপরে হলে আপনি স্থূলকায়।

কোমরের মাপ নিয়েও স্থূলতা ঠাওর করা যায়। কটিদেশের বহর যদি পুরুষদের ৯০ এবং নারীদের ৮০ সেন্টিমিটারের বেশি হয়, তবেই বিপত্তি। এটি নির্দেশ করে পেটে জমে গেছে চর্বির চাঁই। শরীরের অন্য জায়গায় চর্বির আস্তর জমা আর পেটে চর্বির আস্তর জমার মধ্যে বিপদের ফারাক রয়েছে। পেটের চর্বি বেশি খারাপ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হয় ভিসেরাল ফ্যাট। এই চর্বিই যত বিপত্তির উৎপত্তিস্থল। এখান থেকেই তৈরি হয় কয়েক পদের হরমোন, যা নানা বিপাকজনিত জটিলতার সৃষ্টি করে।

শরীরে চর্বি জমে যাওয়ার ধরনের ওপর ভিত্তি করে দেহের আকৃতিকে বলা যায় আপেলের মতো কিংবা নাশপাতির মতো। আপেলের মতো পেটের আকৃতি বিপদের লক্ষণ। নাশপাতির মতো যদি হয়, তবে বিপদ কম। সে জন্য বলা হয়, ‘আপেলের মতো নয়, নাশপাতির মতো হও’।

স্থূলতার কারণ

স্থূলতার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। জন্মগত, গর্ভকালীন জীবন, কৈশোর, বেশ কিছু হরমোনজনিত রোগ (যেমন হাইপোথাইরয়েডিজম, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম, কুশিং সিনড্রোম) এবং কিছু ওষুধ স্থূলতার পেছনে দায়ী। এ ছাড়া নিদ্রাহীনতা, মানসিক চাপ, মানসিক রোগ এবং এতে ব্যবহৃত ওষুধও স্থূলতার পেছনে দায়ী। তবে সব কারণ ছাপিয়ে যেটি স্থূলতার পেছনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা হলো—খাদ্য ব্যবস্থাপনা এবং শারীরিক কসরতের মধ্যে সমন্বয়হীনতা।

অনেকে বেশি ক্যালরিযুক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ করেন, যা চর্বির আকারে শরীরে সঞ্চিত হতে থাকে। আয়েশি যন্ত্রনির্ভর জীবন স্থূলতার প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক, ফ্যাটি লিভার, রক্তে কোলেস্টেরল, আর্থ্রাইটিস, ক্যানসার, অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া, বন্ধ্যত্বসহ অনেক ব্যাধির অন্যতম প্রধান ঝুঁকি এই স্থূলতা। স্থূলকায় নারী-পুরুষদের হতাশায় আক্রান্তের হার বেশি।

পরামর্শ

শরীরকে ফুরফুরে, হালকা করে তুলতে সবার আগে প্রয়োজন স্থির প্রতিজ্ঞা। কতটুকু ওজন কমাবেন, নির্ধারণ করুন। পাল্টে ফেলুন জীবনধারা। খাদ্য গ্রহণে সচেতন হোন। অধিক ক্যালরি–সমৃদ্ধ খাবার বিশেষত চর্বি ও শর্করা কমিয়ে ফেলুন। পেস্ট্রি, মিষ্টি, আইসক্রিম, বার্গার, পিৎজা, কোমল পানীয়, বিরিয়ানি, শর্মাসহ ক্যালরি-টইটম্বুর খাবার থেকে রসনাকে সংযত করুন। শাকসবজি, ফলমূল, গোটা শস্যদানা, মুরগির পাতলা মাংস, মাছকে জায়গা দিন।

ডায়েটিং করতে গিয়ে যেন আবার ভিটামিন ও খনিজ লবণ বাদ পড়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পর্যাপ্ত পানি খান। প্রতিদিন শরীরচর্চার অভ্যাস করুন। মুক্ত বাতাসে প্রাণ খুলে ঘাম ঝরিয়ে হাঁটুন। আস্তে আস্তে হাঁটার পরিমাণ বৃদ্ধি করুন। প্রথম দিনেই তো তিন কিলোমিটার হাঁটতে পারবেন না। এক কিলোমিটার দিয়েই না হয় শুরু করুন। যাঁদের বয়স কম, তাঁরা জগিং করুন অথবা দৌড়ান। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা মুটিয়ে গেলে বিকেলে খেলতে বা জগিং করতে পাঠিয়ে দিন। সারা দিন ঘরে বসে স্ক্রিন কালচারের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসুন। ঘুমের জন্য রাতকে বেছে নিন। অযথা রাত্রি জাগরণের বদ অভ্যাস পরিহার করুন। মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপন করুন। যাঁদের শরীরে হরমোনজনিত ব্যাধি বসত গেড়েছে, তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

লেখক: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), ঢাকা