প্রতিদিন রান্নার সময় নিজেদের অজান্তেই আমরা কিছু ভুল করে থাকি। এতে ভাত–ডাল, মাছ–মাংসসহ সবজির পুষ্টিমান নষ্ট হয় বা কমে যায়। ফলে খাবারের সঠিক পুষ্টি উপাদান থেকে আমরা বঞ্চিত হই। অথচ কিছু বিষয়ে একটু সতর্ক হলেই পুষ্টিমানের অপচয় অনেকটা রোধ করা যায়।
রান্নার সময় খাবারের পুষ্টি উপাদান নষ্ট হওয়ার কিছু কারণ রয়েছে, যেমন হিট সেনসিটিভিটি বা তাপ সংবেদনশীলতা। ভিটামিন সি ও কয়েকটি ভিটামিন বি, যেমন থায়ামিন, ফোলেট উচ্চ তাপমাত্রায় হ্রাস পায়।
জারণ প্রক্রিয়ার কারণে কিছু ভিটামিন এ, সি ও ইসহ কয়েকটি নির্দিষ্ট পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড রান্নার সময় বাতাসের সঙ্গে জাড়িত হয়ে পরিমাণে কমে যায়। আবার পানিতে দীর্ঘক্ষণ ভিজিয়ে রাখলে, সেদ্ধ করলে পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন বি ও সি হ্রাস পায়। সবজির খোসা ছাড়ানো, কাটাকুটি বা কুচি করার সময় কোষের দেয়াল ভেঙে বাতাস ভেতরে প্রবেশ করে।
ফলে কিছু পুষ্টি উপাদানের জারণ ঘটে কমে যায়। খাবারের অম্ল-ক্ষারের সমতার কারণেও কিছু পুষ্টি উপাদান হ্রাস পায়। এ ছাড়া আমাদের রান্নায় কিছু ভুল অভ্যাসের কারণে খাদ্যের পুষ্টিগুণের অপচয় কিছুটা বেশি হয়। যেমন:
দীর্ঘ সময় সেদ্ধ করা বা ভাজার ফলে খাবারের সামগ্রিক পুষ্টি উপাদানের অপচয় হয়।
আমরা বরাবরই উচ্চ তাপে মাছ ভেজে, সবজি রেঁধে খেতে পছন্দ করি। এতে পুষ্টির অপচয়ের পাশাপাশি দেহের জন্য ক্ষতিকারক অনেক উপাদানও তৈরি হয়।
ঘন ঘন খাবার গরম করেও অনেক সংবেদনশীল পুষ্টি উপাদানের অপচয় হয়।
অতিরিক্ত রান্নার ফলেও পুষ্টি কমে যায়। সবজি একেবারে নরম হয়ে গলে যাওয়া পর্যন্ত রান্না করলে পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিনের পরিমাণ কমে যায়।
অনেক সবজির খোসাতে পুষ্টি উপাদানের ঘনত্ব বেশি থাকে। মোটা করে ছিলে কাটলে এসব পুষ্টি উপাদানের অপচয় হয়।
সবজি সেদ্ধ করার পর সেই পানি ফেলে দিলে দ্রবণীয় ভিটামিনের অনেকটাই অপচয় হয়।
রান্নার অনেকক্ষণ আগে সবজি কেটে খোলা বাতাসে রেখে দিলে বাতাসে জাড়িত হয়ে অনেক পুষ্টি উপাদান হারিয়ে যায়।
ভাত রান্নার সময় পুষ্টির অপচয় রোধ করার জন্য অল্প পানিতে চাল ধুয়ে নিন। সেদ্ধ হওয়ার জন্য যতটুকু পানির প্রয়োজন, ঠিক ততটুকু পানি ব্যবহার করুন। বসা ভাত রান্না করলে মাড় ফেলার প্রয়োজন হয় না, এতে অনেক পুষ্টি উপাদান নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পায়।
আলু কাটার আগে ধুয়ে নিতে হয়। কাটার পর আলুর টুকরা পানির মধ্যে রাখা ঠিক নয়। কারণ, ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি২ ও ভিটামিন সি পানিতে দ্রবীভূত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়।
রান্নার ফলে স্নেহ বা চর্বিজাতীয় খাদ্য, যেমন তেল, ঘি, ডালডা ইত্যাদির তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না, পুষ্টিমূল্য প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। তবে অত্যধিক তাপে স্নেহ পদার্থ ভেঙে প্রথমে ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারল উৎপন্ন হয়। পরে এই গ্লিসারিন থেকে অ্যাক্রোলিন নামক বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হয়, যা থেকে পেটের অসুখ হতে পারে। তাই অধিক তাপে রান্না না করাই ভালো।
মাংস রান্নার সময় অল্প পানি ব্যবহার করতে হবে, যেন ধাতব লবণের অপচয় কম হয়। অত্যধিক উত্তাপে মাংসের ‘বি’ ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায়।
ডাল রান্নার সময় উত্তমরূপে সেদ্ধ করা উচিত। কিছু উদ্ভিজ্জ আমিষের অধিক তাপে পুষ্টিমূল্য বৃদ্ধি পায়, যেমন অল্প সেদ্ধ ডাল অপেক্ষা বেশি সেদ্ধ ডাল থেকে শরীর অধিক পরিমাণ আমিষ গ্রহণ করতে পারে।
দুধ ভালোভাবে ফুটিয়ে খাওয়া দরকার। দুধ সহজেই নানা রকম জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত হতে পারে, তাই কাঁচা দুধ বা একবার ফোটানো ঠান্ডা দুধ খেতে হলে পুনরায় ফুটিয়ে নিতে হবে। দুধ জ্বাল দেওয়ার সময় বলক আসার পর প্রায় ১০ মিনিট ফোটাতে হবে। তাপে দুধের পুষ্টিমান নষ্ট হয় না কিন্তু সূর্যের আলোতে রাখলে দুধের ভিটামিন বি২ নষ্ট হয়ে যায়।
শাকসবজি, ফল অনেকক্ষণ খোলা বাতাসে রাখলে পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয়। তাই শাকসবজি টাটকা অবস্থায় খাওয়া উচিত। শাকসবজির পুষ্টিমানের অপচয় রোধ করার জন্য কয়েকটি নিয়ম বর্ণনা করা হলো:
রান্নার ঠিক আগে তাজা শাকসবজি বেছে নিয়ে পরিষ্কার পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে তারপর কাটতে হবে। কাটা শাকসবজি পুনরায় ধোয়া বা পানিতে রাখা যাবে না।
পরিষ্কার ও ধারালো দা বা বঁটি দিয়ে যতটা সম্ভব টুকরা বড় বড় ও সমান সাইজ করে কাটতে হবে। টুকরা ছোট–বড় ও এবড়োখেবড়ো হলে পুষ্টি উপাদান বেশি নষ্ট হয়।
সবজি কাটার সময় যতটা সম্ভব খোসাসহ কাটতে হবে। কারণ, খোসার নিচেই বেশির ভাগ ভিটামিন থাকে। ছুরি বা বঁটি দিয়ে খোসা পুরু করে না কেটে ছিলে বা চেঁছে নিলে ভালো। এতে আঁশ পাবেন বেশি।
কাটার পর সঙ্গে সঙ্গে রান্না করতে হবে। যদি রান্না করতে দেরি হয়, তাহলে সবজিগুলো ঠান্ডা স্থানে ঢেকে রাখা উচিত।
ছোট মুখের গর্তযুক্ত পাত্রে শাকসবজি রান্না করা উচিত। ছড়ানো মুখের পাত্রে রান্না করলে বাতাসের অক্সিজেন সবজির সংস্পর্শে বেশি আসে, ফলে ভিটামিন বেশি নষ্ট হয়।
সেদ্ধ করার জন্য যতটুকু পানি প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই পানি ব্যবহার করতে হবে এবং প্রথমে পানি ফুটিয়ে নিয়ে তাতে সবজি ছাড়লে তাতে খাদ্য উপাদান জারিত হয়ে কম নষ্ট হয়।
শাকসবজির সেদ্ধ করা পানি কোনো মতেই ফেলা উচিত নয়। এ পানি ডাল বা অন্য তরকারির সঙ্গে ব্যবহার করা অথবা শাকের সঙ্গেই শুকিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
শাকসবজি বেশি তাপে অল্প সময়ে রান্না করা উচিত। এত বেশি সেদ্ধ করা উচিত নয়, যাতে গলে যায়। এতে বেশি পুষ্টি নষ্ট হয়।
শাকসবজির স্বাভাবিক রং বজায় রাখা এবং মাংস, ডাল ইত্যাদি তাড়াতাড়ি সেদ্ধ করার জন্য ক্ষারজাতীয় পদার্থ, যেমন সোডা ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ, এতে ভিটামিন সি ও বি নষ্ট হয়ে যায়।
কিছু কিছু শাকসবজি, যেমন ধনেপাতা, পুদিনা পাতা, লেটুস পাতা, গাজর, মুলা, শসা ইত্যাদি কাঁচা খাওয়া ভালো। রান্নায় এগুলোর পুষ্টিগুণ কমে যায়।
রান্নায় সামান্য ভিনেগার বা লেবুর রস ব্যবহার করলে ভিটামিন বি ও সি অনেকটা রক্ষা পায়।
লোহা বা তামার পাত্রে রান্না না করে মাটির বা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে রান্না করা উচিত। কারণ, লোহা ও তামার সংস্পর্শে ভিটামিন সি নষ্ট হয়ে যায়।
একবার ব্যবহার করা তেল ছেঁকে ভাজলে ক্ষতিকর ট্রান্স ফ্যাট বাড়ে। একই তেল দিয়ে বারবার পিঠা, জিলাপি ইত্যাদি ভাজা ঠিক নয়; বরং ভাজার জন্য যতটুকু তেলের দরকার, ঠিক ততটুকু তেলই ব্যবহার করা শ্রেয়।
নারকেল তেলের স্মোক পয়েন্ট (যে তাপমাত্রায় তেল বা চর্বি ধোঁয়া নির্গত করতে শুরু হয়) বেশি। তাই অনেকক্ষণ উচ্চ তাপে গরম করলেও তা মোটামুটি অবিকৃত থাকে ও বিপদ কম হয়।
স্বাদের খাতিরে সপ্তাহে এক–আধবার ভাজাপোড়া অল্প করে খেতেই পারেন। তবে ছাঁকা তেলে না ভেজে কড়াইয়ে অল্প তেল দিয়ে ভাজুন।
ফাহমিদা হাশেম, সিনিয়র পুষ্টিবিদ, ল্যাবএইড ও ফিটব্যাক