শারীরিক ও মানসিক কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে দেখা গেছে, দুই সময়ের গোসলেরই কিছু ভালো ও মন্দ দিক আছে। মডেল: রাতুল
শারীরিক ও মানসিক কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে দেখা গেছে, দুই সময়ের গোসলেরই কিছু ভালো ও মন্দ দিক আছে। মডেল: রাতুল

কখন গোসল করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো—সকালে নাকি রাতে? বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে বাইরে যাওয়ার অভ্যাস অনেকেরই। অনেকে আবার কাজ শেষে বাইরে থেকে ফিরে একেবারে সন্ধ্যায় বা রাতে গোসল সেরে নেন। প্রথম পক্ষের লোকজন বিশ্বাস করেন, সকালের গোসল শরীরকে সারা দিনের জন্য প্রস্তুত করে দেয়। বিপরীতে অপর পক্ষের লোকজন মনে করেন, দিন শেষে গোসল করলে সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়; রাতের ঘুমটাও হয় ভালো। এই দুই পক্ষ ছাড়াও আরও এক পক্ষ আছে, যারা সকালে এবং রাতে—দিনের দুই সময়ই গোসল করতে অভ্যস্ত। প্রশ্ন হলো, ঠিক কোন সময়ের গোসল স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী? শারীরিক ও মানসিক কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে দেখা গেছে, দুই সময়ের গোসলেরই কিছু ভালো ও মন্দ দিক আছে। জেনে নিন বিস্তারিত—

রাতে উষ্ণ পানি দিয়ে গোসল করলে যা হয়

রাতে যখন আমাদের ঘুমানোর সময় হয়, তখন শরীরের সারকাডিয়ান রিদম বা জৈবছন্দ শরীরের অভ্যন্তরীণ মূল তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। এই তাপমাত্রা হ্রাসের ঘটনা আমাদের মস্তিষ্কককে ঘুম আনয়নের তাগিদ দেয়। এর ঠিক উল্টোটা ঘটে সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সময় হলে শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা আবার বাড়তে শুরু করে। ফলে ঘুমন্ত মস্তিষ্ক জেগে ওঠার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।

রাতে গোসল করার পানিটা ঠান্ডা নাকি উষ্ণ—তার প্রভাব আছে আমাদের ঘুমের ওপর। মার্কিন চিকিৎসক ও ঘুমবিষয়ক পরামর্শক ড. রবার্ট ওয়েক্সমেন বলেন, রাতে ঘুমের আগে উষ্ণ পানি দিয়ে গোসল করে নিলে শরীরের অভ্যন্তরীণ মূল তাপমাত্রা কমে যেতে শুরু করে। ফলে ঘুম আসে দ্রুত এবং ঘুমটা হয় আরামদায়ক। তবে তিনি এ–ও বলেন, যদিও রাতে উষ্ণ পানি দিয়ে গোসল করা ঘুমের জন্য ভালো, এটি না করলেও তেমন কোনো ক্ষতি নেই। কেননা, আমাদের শরীরের সারকাডিয়ান রিদম নিজে থেকেই শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে দিয়ে ঘুম আনয়নে সাহায্য করে।

ওয়েক্সমেনের মতে, কেউ যদি রাতে ঘুমের আগে উষ্ণ পানি দিয়ে গোসল করার উপকারিতা ভালোভাবে পেতে চায়, তাহলে রাতে ঘুমের আগে অন্তত আধঘণ্টা বা তারও কম সময়ের মধ্যে গোসলটা সেরে নিতে হবে।

রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে যা হয়

অনেকে আবার রাতে ঘুমানোর আগে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে পছন্দ করেন। তাঁরা মনে করেন, ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে ঘুমটা ভালো হয়। যদিও ওয়েক্সমেন এ ঘটনার বৈজ্ঞানিক সত্যতা নেই বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে শরীরের ‘ব্রাউন ফ্যাট’ বা বাদামি অ্যাডিপজ টিস্যু সক্রিয় হয়। এই বাদামি অ্যাডিপজ টিস্যুগুলো অন্য সময় শক্তি সঞ্চয় করে রাখে। পরে শরীর ঠান্ডা হলে এই টিস্যু সঞ্চিত শক্তি ক্ষয় করে শরীরকে উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে। ব্রাউন ফ্যাট বা বাদামি অ্যাডিপজ টিস্যু সক্রিয় হলে আবার ঘুম দ্রুত আসে। তবে ঘুমানোর আগে খুব ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে আমাদের ত্বকে রক্তপ্রবাহ কমে গিয়ে শরীরের অভ্যন্তরীণ মূল তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার এই ঘটনা ব্রাউন ফ্যাট সক্রিয় হওয়ার ফলে ঘুম দ্রুত আসার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। অর্থাৎ রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসলের তেমন কোনো বৈজ্ঞানিক উপকারিতা নেই।

তাই সব দিক বিবেচনা করে এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে গোসল সকাল সকাল সেরে নেওয়াই ভালো। ওয়েক্সমেন মনে করেন, রাতে কারোর ঘুম ঠিকঠাক হোক বা না হোক, সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসলটা সেরে নিলে শরীরে ঘুম ঘুম ভাবটা আর থাকে না।

রাতে ঘুমানোর আগে গোসল দিবে আরাম। মডেল : সৌমি

ত্বকের ওপর সকালে বা রাতে গোসলের প্রভাব যেমন

সকালে বা রাতে—গোসল যখনই হোক, ত্বকের জন্য তা উপকারই বয়ে আনে। কানাডিয়ান চর্মরোগবিশেষজ্ঞ ড. জুলিয়া ক্যারোল জানান, দিনে আপনি কখন গোসল করলেন, তা আমাদের ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য তেমন পার্থক্য বয়ে আনে না। গোসল করলে ত্বক পরিষ্কার হয়, তেল এবং অন্যান্য দূষণকারী পদার্থ দূর হয়। তবে রাতে গোসল করলে সারা দিনে ত্বকে জমা হওয়া ধুলা-ময়লা ও জীবাণু শরীর থেকে অপসারিত হয়।

জুলিয়া বলেন, নিয়মিত গোসলের মতো গোসলের পর যথাযথ ময়েশ্চারাইজিংও ত্বকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। খুব গরম পানি দিয়ে গোসল করলে ত্বকের প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার ক্ষয়ে গিয়ে ত্বককে করে দেয় শুষ্ক, সৃষ্টি হতে পারে প্রদাহ। তাই দিনে যখনই গোসল করুন না কেন, গোসলের সময় ফুটন্ত গরম পানি ব্যবহার না করে কুসুম কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন। গোসলের পরপরই ভালো কোনো (ত্বকে প্রদাহ সৃষ্টি করবে না এমন) ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে।

জুলিয়া মনে করিয়ে দিয়েছেন, সকালে অনেকেরই কাজে বের হওয়ার তাড়া থাকে। ফলে সকালে গোসলের পর অনেকেই ঠিকমতো ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পান না। এদিক থেকে রাতে গোসল করার পর হাতে বেশ কিছু সময় পাওয়া যায় বলে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করে ত্বক আর্দ্র রাখা যায়।

চুলের স্বাস্থ্যের ওপর রাতের গোসলের প্রভাব

চুলের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হেয়ারনোহাউয়ের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জনাথন পামা বলেন, চুল ভেজা থাকার সময়টা আমাদের চুলের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ স্পর্শকাতর। শুষ্ক চুলের চেয়ে ভেজা চুল অনেক বেশি ক্ষয়প্রবণ হয়। রাতে গোসল করলে ভালোভাবে শুকানোর আগেই ভেজা চুল নিয়ে বিছানায় গেলে বালিশের সঙ্গে ঘষা লেগে চুলের কিউটিকলের ক্ষতি হয়। বিশেষ করে, লম্বা চুল যাঁদের, তাঁদের জন্য এই ক্ষতি আরও বেশি হয়। চুলের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায়, চুল পুরোপুরি শুষ্ক থাকা অবস্থায় ঘুমানো সবচেয়ে নিরাপদ। তাই রাতে যাঁরা গোসল করেন, তাঁদের উচিত বিছানায় ঘুমাতে যাওয়ার আগে চুল খুব ভালো করে শুকিয়ে নেওয়া। খুব ভালো হয় সকালে গোসল করে নিলে। কেননা, সকালে গোসল করলে চুল ধীরে ধীরে এমনিতেই ভালোভাবে শুকিয়ে যায়। ফলে ক্ষতিকর হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করে আয়োজন করে চুল শুকানোর প্রয়োজন পড়ে না।

পামার এসব পরামর্শ লম্বা চুলের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। যাঁদের চুল ছোট, তাঁদের চুলে এ ধরনের ক্ষয় হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। কেননা, ছোট চুল সহজেই শুকিয়ে যায় কোনো ক্ষতি হওয়ার আগেই।

মানসিক চাপ প্রশমনে গোসলের প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস হেলথ রিসোর্সেসের একটি গবেষণা বলছে, ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করার ফলে শরীরে অ্যাড্রেনালিন হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। এই হরমোন আমাদের হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ ও শ্বসনক্রিয়া বাড়িয়ে মানসিক সতর্কতা ও মনোযোগ বৃদ্ধি করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থা বেকেয়ার বলছে, উষ্ণ পানি দিয়ে গোসল করলে আমাদের মানসিক চাপ কমে যায়। উষ্ণ পানির সংস্পর্শ পেলে আমাদের দেহের মাংসপেশি শিথিল হয়, মন প্রফুল্ল ও চিন্তামুক্ত হয়। ফলে ঘুমের প্যাটার্ন ঠিক হয়, রক্তপ্রবাহ বাড়ে এবং শরীরের ব্যথাবেদনা ও প্রদাহ কমে যায়।

সূত্র: হাফিংটন পোস্ট