প্রোটিনিউরিয়া কী
প্রস্রাবের সঙ্গে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণ প্রোটিন বেরিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে প্রোটিনিউরিয়া। কখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, জেনে নিন।
কিডনি অনেকটা ছাঁকনির মতো কাজ করে। পরিশোধনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি শরীরে দরকারি উপাদান ধরে রেখে প্রস্রাবের মাধ্যমে ক্ষতিকর জিনিস বের করে দেয়। এতে রক্ত পরিশুদ্ধ থাকে। ছাঁকনির ছিদ্র বা গঠনে কোনো তারতম্য হলে যেমন কাঙ্ক্ষিত কাজটি সঠিকভাবে হয় না, কিডনির বেলায়ও তা-ই। কোনো কোনো রোগে কিডনির স্বাভাবিক ছাঁকন-প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে শরীর থেকে অতিরিক্ত প্রোটিন বেরিয়ে যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় একটু বড় আকারের প্রোটিন (যেমন অ্যালবুমিন) কিডনির ছাঁকনি পেরোতে পারে না, গেলেও তা সারা দিনে ৩০ মিলিগ্রামের কম। কিন্তু ছাঁকনির ছিদ্রে কোনো ত্রুটি থাকলে অ্যালবুমিনের মতো অতি জরুরি প্রোটিনও অনায়াসে বেরিয়ে যায়।
সারা দিনে প্রস্রাবের সঙ্গে ১৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত প্রোটিন নির্গত হওয়াটা স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যে পড়ে। এর বেশি বেরিয়ে যাওয়াটা খারাপ। তখন স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি প্রোটিন বেরিয়ে যাওয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় প্রোটিনিউরিয়া।
কেন হয় প্রোটিনিউরিয়া
বাংলাদেশে প্রোটিনিউরিয়ার প্রধান কারণ হলো কিডনির প্রদাহ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয় গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে, বিশেষ করে যাঁদের ডায়াবেটিস কিংবা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নেই। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনির রক্তনালিতে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটে, পরিণতিতে প্রস্রাব দিয়ে প্রোটিন বেরিয়ে যেতে পারে। দেশে প্রোটিনিউরিয়ার কারণ হিসেবে প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই এই তিন রোগ দায়ী।
এর বাইরেও কিছু রোগ রয়েছে, যাতে প্রস্রাবের সঙ্গে প্রোটিন বের হয়ে যেতে পারে। যেমন ভাস্কুলাইটিস (রক্তনালির প্রদাহ), লুপাস নেফ্রাইটিস, মাল্টিপল মায়েলোমা (রক্তের একধরনের ক্যানসার) এবং অ্যামাইলয়েডোসিস (এ রোগে শরীরে অস্বাভাবিকভাবে প্রোটিন জমা হয়)। তবে এমন রোগীর সংখ্যা কম। পানিশূন্যতা, সংক্রমণ বা জ্বরের সময়, প্রস্রাবে সংক্রমণ হলে বা খুব ভারী ব্যায়াম করলে সাময়িকভাবে প্রোটিন নির্গত হতে পারে।
আমাদের দেশে এখনো বহু মানুষ দৈনন্দিন চাহিদা অনুযায়ী প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার সামর্থ্য রাখেন না। তাই আমাদের শর্করা গ্রহণের হার বেশি। শর্করা শরীরে জমা হতে থাকে। বাড়ে মেদ। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে। তবে একজন সুস্থ ব্যক্তি প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ করলে কিডনির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তাই কার জন্য রোজ কতটুকু প্রোটিন প্রয়োজন, জেনে রাখা প্রয়োজন। এর একটি সহজ হিসাব রয়েছে। আপনার ওজন যত কেজি, ঠিক তত গ্রাম প্রোটিন আপনাকে রোজ খেতে হবে। যদি আপনার ওজন ৬০ কেজি হয়, তবে খেতে পারবেন ৬০ গ্রাম প্রোটিন।
একটি বড় সাইজের ডিমে ৬ থেকে ৮ গ্রাম প্রোটিন থাকে। ১০০ গ্রাম মুরগির মাংসে প্রোটিন থাকে ২৬-২৭ গ্রাম। বিভিন্ন ধরনের মাছে প্রোটিনের পরিমাণে তারতম্য থাকে। তবে মোটামুটি ১০০ গ্রাম মাছে ২২-২৬ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায়। টুনা মাছে প্রোটিন বেশি। ১ কাপ দুধে থাকে ৭-৮ গ্রাম প্রোটিন। আপনার ওজন যদি ৬০ কেজি হয়, তাহলে দিনে ১০০ গ্রাম মাংস, ১০০ গ্রাম মাছ, ১টি ডিম আর আধা কাপ দুধ খেলেই আপনার প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয়ে যাবে।
কিডনির রোগ প্রোনিউরিয়ার ঝুঁকি কমাবেন কীভাবে?
প্রোটিনিউরিয়া ও কিডনির যেকোনো রোগ প্রতিরোধে সুস্থ জীবনধারা গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
সুষম খাদ্যাভ্যাস আবশ্যক। শর্করা, প্রোটিন, স্নেহজাতীয় খাবার যেমন চাই প্রয়োজনমাফিক, তেমনি চাই প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল। পর্যাপ্ত পানিও খেতে হবে রোজ।
শরীরটাকে সচল রাখুন। কায়িক শ্রম চাই-ই চাই। শরীরচর্চা বা খেলাধুলার মতো কাজে সময় দিন রোজ, যাতে শারীরিক শ্রম হয়।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। আপনার উচ্চতা অনুযায়ী কোনটি আপনার জন্য সঠিক ওজন, জেনে নিন। সেই সীমার মধ্যেই রাখুন নিজের ওজন। বাড়তি ওজন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিও বাড়ায়।
ধূমপান অবশ্যই বর্জন করুন। ধূমপানের ফলে কিডনির রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এমনকি নিজে ধূমপায়ী না হলেও অন্যের সিগারেটের ধোঁয়া আপনার কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই সবাইকেই ধূমপানে নিরুৎসাহিত করুন।
৪০ পেরোলে প্রতিবছরই অন্তত একবার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো প্রয়োজন।
আপনি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ বোধ করলেও এসব পরীক্ষা করানো জরুরি।
আপনার ডায়াবেটিস কিংবা কিডনির রোগ আছে কি না, প্রস্রাবে প্রোটিন যাচ্ছে কি না, রক্তচাপ কেমন থাকছে—এ বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন। মনে রাখবেন, এ ধরনের রোগ কিন্তু কোনো উপসর্গ ছাড়াই আপনার শরীরে বাসা বেঁধে থাকতে পারে বছরের পর বছর।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কিডনির রোগ থাকলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকুন। এই রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য চিকিৎসকের সব পরামর্শ মেনে চলুন।
প্রোটিনিউরিয়ার ঝুঁকি কাদের বেশি
যাঁরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
যাঁরা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন।
যাঁদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।
যাঁদের পরিবারে কারও প্রোটিনিউরিয়ার ইতিহাস আছে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রোটিনিউরিয়া ও কিডনি বৈকল্যের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তাই ডায়াবেটিসের রোগীদের প্রস্রাবের অন্য একটি পরীক্ষা করারও পরামর্শ দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে প্রোটিনিউরিয়া একেবারে প্রাথমিক অবস্থাতে শনাক্ত করা যায়। এটা হলো ইউরিনারি এসিআর (অ্যালবুমিন ক্রিয়েটিনিন রেশিও)। পরীক্ষাটি একটু ব্যয়বহুল হলেও বছরে একবার এটি করানোর মাধ্যমে ভবিষ্যতের অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত খরচ বাঁচানো সম্ভব। দীর্ঘমেয়াদি কিডনির রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও বছরে অন্তত একবার পরীক্ষাটি করানো উচিত।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, কিডনি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল