জন্ডিসকে অনেকেই রোগ হিসেবে জানলেও এটি আসলে রোগের উপসর্গ। জন্ডিস বেশ কয়েকটি রোগের কারণে হয়ে থাকে। লিভার, পিত্তনালি এবং রক্তের কিছু রোগের কারণে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে জন্ডিস দেখা দেয়। তবে বিশ্বব্যাপী জন্ডিসের প্রধান কারণ হচ্ছে হেপাটাইটিস ভাইরাসজনিত লিভারের প্রদাহ। মেডিকেলের ভাষায় এটাকে বলে অ্যাকিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস। আমাদের দেশে হেপাটাইটিস এ এবং ই ভাইরাস জন্ডিসের জন্য মূলত দায়ী। পানি ও খাবারের সঙ্গে মিশে এ দুটি ভাইরাস ছড়ায়। সারা বছর ভাইরাস দুটির সংক্রমণ দেখা গেলেও গ্রীষ্ম ও বর্ষায় আক্রান্তের হার বেড়ে যায়। এ বছর মার্চ–এপ্রিল থেকে শুরু করে এখনো গরম ও বৃষ্টি—দুটিই সমানতালে বিদ্যমান। তাই এই সময়েও অনেকে ভাইরাসজনিত জন্ডিসে ভুগছে।
হালকা জ্বর, বমি বমি ভাব কিংবা বমি, খাবারে অরুচি—এসব উপসর্গ দেখা দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে জন্ডিস দেখা দেয়। এই জন্ডিস শিশুদের ক্ষেত্রে কয়েক দিনের মধ্যে সেরে যায়। বড়দের ক্ষেত্রে এক-দুই সপ্তাহ বাড়ে, পরে ধীরে ধীরে কমে, দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তবে ২-৩ শতাংশ ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়।
কয়েক বছর আগেও আমাদের দেশসহ উপমহাদেশে হেপাটাইটিস এ ছিল মূলত শিশুদের সংক্রমণকারী ভাইরাস। শিশুদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ থাকে না। বাবা–মায়ের পক্ষে তাই জানাও সম্ভব হয় না, কখন শিশুটি সংক্রমিত হয়ে ভালো হয়ে গেল। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয় না। তবে কিছু শিশুর মৃদু উপসর্গ দেখা দেয়। গবেষণা বলে, ১০ বছর বয়সের মধ্যেই আমাদের দেশের শিশুদের ৯০ ভাগ হেপাটাইটিস এ-তে সংক্রমিত হয়ে যায়। অপর দিকে, কিশোর বা প্রাপ্তবয়স্কদের হেপাটাইটিসজনিত জন্ডিস হয় প্রধানত হেপাটাইটিস ই দ্বারা, হেপাটাইটিস এ সংক্রমণ বিরল।
এই বছর কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যাঁরা জন্ডিস নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশই আক্রান্ত হেপাটাইটিস এ দ্বারা, ই দ্বারা নয়। অর্থাৎ, হেপাটাইটিস এ শিশুদের ভাইরাস—এই ডেমোগ্রাফিক বৈশিষ্ট্যের ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। এই জন্ডিস সারতে সময় লাগছে অনেক বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেড় থেকে দুই মাস, কারও কারও ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় লাগছে। জটিলতার হারও বেশি।
হেপাটাইটিসের উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জন্ডিসের মাত্রা ও কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন। বাড়িতে বিশ্রামে থাকতে হবে। অতিরিক্ত বমি বা দুর্বলতা, জন্ডিসের উচ্চমাত্রা কিংবা লিভারের কার্যক্ষমতা হ্রাস—এসব ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়।
প্রতিরোধ কীভাবে করবেন
বিশুদ্ধ পানি ও নিরাপদ খাবার গ্রহণ করতে হবে। খাওয়ার আগে হাত ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। রাস্তায় বিক্রি হওয়া খোলা খাবার বা পানীয় খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। হেপাটাইটিস এ–প্রতিরোধী একটি টিকা রয়েছে। এত দিন পর্যন্ত এই টিকাকে গুরুত্ব দেওয়া না হলেও এখন সব শিশুকে এই টিকা দেওয়ার কথা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
ডা. ফয়েজ আহমদ খন্দকার, সহযোগী অধ্যাপক, হেপাটোলজি বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ