সন্তান প্রসবের জন্য আছে বিভিন্ন পদ্ধতি। সবচেয়ে সাধারণ দুটি পদ্ধতি হলো নরমাল ডেলিভারি বা স্বাভাবিক প্রসব ও সিজারিয়ান (সি) সেকশন। কীভাবে প্রসব হবে, এ নিয়ে শুরু থেকেই দুশ্চিন্তায় থাকেন সন্তানপ্রত্যাশী দম্পতিরা। এ নিয়ে আমাদের সমাজে আছে নানা বিভ্রান্তিও। জেনে রাখুন বিস্তারিত।
বাংলাদেশে এখন উল্লেখযোগ্য হারে প্রসব হচ্ছে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে। দেশে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে শিশু জন্মের হার ৮ গুণ বেড়েছে। ২০০৪ সালে এই হার ছিল ৪ শতাংশ, যা ২০১৭-১৮ সালে এসে দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশে। ২০২২ সালে বাংলাদেশে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারির হার ৬৯ শতাংশ ও সিজারিয়ান ডেলিভারির হার ৩১ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এ হার ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে হওয়া প্রতি ১০ জনের মধ্যে ছয়জনের সি-সেকশনই এড়ানো যেত।
স্বাভাবিক প্রসবপ্রক্রিয়া প্রাকৃতিক ও পরীক্ষিত পদ্ধতি। এটি বহু শতাব্দী ধরে চলে আসছে এবং এর সুবিধা সুস্পষ্ট। নরমাল ডেলিভারির ফলে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি কম থাকে। এ ছাড়া শিশু ও মায়ের দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি কমায়।
স্তন্যদান তাড়াতাড়ি শুরু করা যায়
নরমাল ডেলিভারিতে প্রসববেদনা বেশি হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কোনো কাটাকাটির ঝামেলা থাকে না বলে প্রসব–পরবর্তী সময়ে মা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারেন।
স্বাভাবিক প্রসবের পর মাত্র ১ দিন হাসপাতালে থাকতে হয় এবং মায়ের প্রসব–পরবর্তী যত্নও অল্প সময়ের জন্য নেওয়া লাগে। ডেলিভারির পর বাড়তি সাহায্যকারী কম লাগে। ওষুধ ও ব্লাড ট্রান্সফিউশন বা রক্ত দিতে হয় কম। ফলে খরচও কম।
জরায়ুর পেশি ও যোনিপথ একসঙ্গে কাজ করে, যাতে শিশুকে নিচে ও বাইরে যেতে সাহায্য করে। নরমাল ডেলিভারিতে সক্ষম নারীরা সিজারিয়ানদের থেকে বেশি কর্মক্ষম হন।
প্রসবের পর অস্ত্রোপচার–পরবর্তী জটিলতাগুলো, যেমন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, সেকেন্ডারি ইনফেকশন, স্থূলতার আশঙ্কা কম থাকে।
পরবর্তী গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক প্রসবের সম্ভাবনা বেশি থাকে; ভবিষ্যতে গর্ভাবস্থার জটিলতা, যেমন মৃত প্রসব ও গর্ভপাতের আশঙ্কা কম থাকে।
সি-সেকশনের তুলনায় স্বাভাবিক প্রসবের পরে বন্ধ্যত্ব ও প্রজনন সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।
নরমাল ডেলিভারির সময় শিশুর শরীরে কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে, যা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায় এবং জন্মের প্রথম দিনগুলোয় শিশুকে বিভিন্ন রোগজীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
নরমাল ডেলিভারিতে শিশুর পুরো শরীরের সঙ্গে ফুসফুসও সংকুচিত হয়। এতে ফুসফুসের ভেতরে থাকা অপ্রয়োজনীয় জলীয় পদার্থ বেরিয়ে যায়। ফলে তার ফুসফুস স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে। শিশুর হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি কমায়। ফুসফুসের ক্ষমতাও ভালো থাকে।
স্বাভাবিক প্রসব হলে শিশু কোনো সমস্যা ছাড়াই মায়ের দুধ সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারে। মায়ের দুধে ঘন ও হলুদাভ তরল কোলোস্ট্রাম থাকে, যা প্রোটিন ও ইমিউনোগ্লোবুলিন-সমৃদ্ধ। কোলোস্ট্রাম শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে, অপরিণত পরিপাকতন্ত্রের বিকাশে সাহায্য করে এবং শিশুর ইমিউন সিস্টেম তৈরি করতে সাহায্য করে।
নরমাল ডেলিভারি হওয়া শিশুর শারীরিক সক্ষমতা সিজারিয়ানদের তুলনায় বেশি হয়।
মায়ের সঙ্গে শিশুর অ্যাটাচমেন্ট বা অনুরক্তি তাড়াতাড়ি হয়।
তবে নরমাল ডেলিভারিতে কিছু ঝুঁকিও থাকে, যেমন যোনি বা পেরিনিয়াম ছিঁড়ে যাওয়া বা ফেটে যাওয়া, যা সংক্রমণের কারণ হতে পারে।
স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান করা মায়েদের মৃত্যুঝুঁকি তিন গুণ বেশি।
সিজারিয়ান শিশু মায়ের দুধপানে বেশি সমস্যার মুখে পড়ে। সিজারিয়ান অপারেশনে মাকে অস্ত্রোপচারের জন্য যেসব চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, তা নবজাতকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বুকের দুধপানে বাধা তৈরি করে।
সি-সেকশনে জন্ম নেওয়া শিশুদের প্রাইমারি পালমোনারি উচ্চ রক্তচাপ পাঁচ গুণ বেশি। সিজারিয়ান শিশুর রক্তে সংক্রমণের হার বেশি, এমনকি থাকে জন্ডিস দেখা দেওয়ার আশঙ্কা।
সি-সেকশনে জন্ম নেওয়া শিশু পরবর্তী সময়ে সিজোফ্রেনিয়ার মতো গুরুতর মানসিক রোগে ভোগার ঝুঁকিতে থাকে।
সিজারিয়ান শিশুদের মধ্যে অ্যালার্জি ও হাঁপানির প্রবণতা বেশি থাকে। এ ছাড়া ডায়রিয়া হওয়ার ঝুঁকি ৪৬ গুণ বেশি থাকে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে মা ও শিশু উভয়ের কথা চিন্তা করে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন। যেমন—
যখন মায়ের প্রসব-পথ সরু বা চাপা থাকে
প্রসবের পথে যদি কোনো টিউমার থাকে
গর্ভফুল নিচের দিকে থাকলে
শিশুর অবস্থান আড়াআড়ি বা উল্টা থাকলে
শিশুর ওজন অতিরিক্ত বেশি হলে অথবা মাথার আয়তন প্রসব-পথের চেয়ে বড় হলে
প্রসবের আগে মায়ের রক্তক্ষরণ শুরু হলে
মায়ের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থাকলে
ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো জটিল রোগ থাকলে
আগের দুটি সন্তান সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি হলে
প্রসববেদনা ওঠার ৬ থেকে ১৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বাভাবিকভাবে ডেলিভারি না হলে
৩৫ বছর বয়সের পর অথবা ১৯ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে প্রথমবারের মতো গর্ভধারণ করলেও সিজার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে
প্রসবের জন্য কোন পদ্ধতি নারীর জন্য প্রযোজ্য হবে, তা কোন পদ্ধতি তুলনামূলক ভালো বা খারাপ, সেটির ওপর নির্ভর করে না; বরং নারীর শারীরিক ও গর্ভকালীন অবস্থা, ঝুঁকি এবং সর্বোপরি মা ও শিশুর নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নরমাল ডেলিভারি প্রাকৃতিক। এটার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। চিকিৎসক যদি বলেন, নরমাল ডেলিভারির জন্য নারী উপযুক্ত, তাহলে প্রসববেদনার ভয় না করে নরমাল ডেলিভারি করানোর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা উচিত।
আবার নরমাল ডেলিভারি সুবিধাজনক, সাশ্রয়ী ও সবার কাম্য হলেও কিছু কিছু পরিস্থিতিতে নরমাল ডেলিভারি মা ও শিশু উভয়েরই মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বা মৃত্যুর কারণও হতে পারে। সেখানে অবশ্যই সিজার করতে হবে। কাজেই কোনো নারীর ডেলিভারি সিজার নাকি নরমাল হবে, সে সিদ্ধান্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ওপর ছেড়ে দিন।
ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন, এমডি গবেষক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা