নখ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। আলফা-ক্যারোটিন প্রোটিন দিয়ে তৈরি হয় নখ, যার প্রধান কাজ নিচে থাকা ত্বককে সুরক্ষা দেওয়া। অনেক রোগের আভাস নখে ধরা পড়ে। এ জন্য চিকিৎসকেরা রোগী পরীক্ষার সময় প্রায়ই নখ দেখে থাকেন। নানা রোগে নখের রং, আকৃতি-প্রকৃতির পরিবর্তন হয়। নখের এ ধরনের পরিবর্তনকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত।
নখের এমন একটি সমস্যা হলো সাদা গুটি বা মিল্ক স্পট। সাদা বাংলায় এটিই নখের ফুল। নখে সাদা দাগ দেখে অনেকে উদ্বিগ্ন হন, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আবার প্রচলিত ধারণা হলো, ক্যালসিয়ামের অভাবে নখে সাদা দাগ পড়ে। তা-ও ঠিক নয় পুরোপুরি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে নখের সাদা দাগ বা নখের ফুলের নাম ‘punctate leukonychia’৷ এর পেছনে কিছু কারণ থাকে। আসুন কারণগুলো জেনে নিই—
অধিকাংশ সময়ে এই দাগের কারণ আঘাত। ক্রমাগত নখ দিয়ে টেবিলে আঁচড়ানো বা আওয়াজ করা, দাঁত দিয়ে নখ কাটা, নখ দিয়ে টিনের মুখ খোলা ইত্যাদি কারণে এটা হতে পারে। ম্যানিকিউর করার সময়ও এ ধরনের ক্ষতি হতে পারে, বিশেষ করে ধারালো সরঞ্জাম দিয়ে ম্যানিকিউর করার সময় সতর্ক না থাকলে। খুব ঘন ঘন ম্যানিকিউরও নখের ক্ষতির কারণ হতে পারে। ম্যানিকিউরের জেল বা অ্যাক্রিলিক থেকে অ্যালার্জিক রি-অ্যাকশন হিসেবে এই দাগ হতে পারে।
নখের সাদা দাগের আরেকটি সাধারণ কারণ ছত্রাক। উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশে ছত্রাকের সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায়। পরিবেশ থেকে জীবাণুগুলো নখ বা আশপাশের ত্বকে ছোট ফাটল দিয়ে প্রবেশ করে, এমনকি নখ কাটার সরঞ্জাম থেকেও সংক্রমণ হতে পারে। ছত্রাক সংক্রমণের অন্যান্য লক্ষণ হলো নখ ফাটা, নখ মোটা হয়ে যাওয়া বা হলুদ বা বাদামি রং ধারণ করা। চিকিৎসায় অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ নিরাময় হতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।
নেইল প্লেট নির্দিষ্ট অনুপাতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান দিয়ে তৈরি। তাই পুষ্টির ঘাটতি হলে নখের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। ক্যালসিয়াম, সেলেনিয়াম, জিংকের মতো খনিজগুলোর অভাবে নখে সাদা দাগ পড়তে পারে। তবে এ বিষয়ে বিতর্ক আছে। খনিজের ঘাটতির অন্যান্য লক্ষণগুলো হলো: শুষ্ক ত্বক, ভঙ্গুর নখ, পেশির ব্যথা, চুলপড়া, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, সাধারণ সর্দির মতো ঘন ঘন সংক্রমণ, ক্ষুধা কমে যাওয়া।
কিছু ওষুধ আপনার নখের বৃদ্ধিতে বাধা দিতে পারে, যার ফলে নখজুড়ে সাদা রেখা দেখা যায়। যেমন: ক্যানসারের জন্য কেমোথেরাপির ওষুধ, ব্রণ চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেটিনয়েড, সালফোনামাইডসহ কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, লিথিয়াম, খিঁচুনির রোগের ওষুধ। এই ওষুধগুলোয় নখ পাতলা হয়ে ভঙ্গুরতার মতো সমস্যা হতে পারে।
বিরল ক্ষেত্রে, সাদা দাগ আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত ভারী ধাতুর বিষক্রিয়ার কারণেও হতে পারে। আর্সেনিক দূষিত খাবার/ পানি দীর্ঘদিন সেবনে এ রকম হয়ে থাকে। আর্সেনিক বিষক্রিয়ার ফলে নখজুড়ে ‘মিউস লাইন’ নামে সাদা ব্যান্ড তৈরি হয়। এর সঙ্গে থাকতে পারে মাথাব্যথা, তন্দ্রা, বিভ্রান্তি, ডায়রিয়া, বমি, হাত-পায়ে জ্বালাপোড়া, কালো ছোপ ছোপ দাগ।
এ ছাড়া বংশগতভাবে পাওয়া কোনো জিনগত বৈশিষ্ট্যের জন্য নখে সাদা দাগ হতে পারে। একে বলা হয় ‘টোটাল কনজেনিটাল হেরেডিটরি ল্যুকোনিকিয়া’।
নখের ফুল অথবা কিছু জায়গায় সাদা দাগ সাধারণত খুব গুরুতর বিষয় নয়। বেশির ভাগই আঘাতের কারণে হয়। কিন্তু আপনার নখটি যদি পুরো সাদা হয়ে যায়, তাহলে সতর্ক হওয়া উচিত। একে বলা হয় লিউকোনাইকিয়া। এটি রক্তে প্রোটিনের স্বল্পতাকে নির্দেশ করে। লিভার, কিডনি বা হার্টের সমস্যায় এমন হয়।
১. নখ আর্দ্র রাখুন। পা ও হাত ভালোভাবে ধুয়ে সম্পূর্ণ শুকিয়ে নিন। এ ক্ষেত্রে ‘কিউটিকল অয়েল’ অত্যন্ত উপকারী।
২. দাঁতে নখ কামড়ানো বা নখ দিয়ে কিছু খোঁচানো থেকে বিরত থাকুন।
৩. প্রতিদিন মোজা পরিবর্তন করুন। বায়ু চলাচল করতে পারে এবং খুব টাইট নয়, এমন জুতা ব্যবহার করুন। নয়তো ছত্রাকের সংক্রমণ হতে পারে।
৪. নখ কাটার সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করুন। প্রত্যেকের আলাদা নেইল কাটার ব্যবহার করা উচিত।
৫. অ্যালার্জি হলে নেইল পলিশ, আঠা ইত্যাদি ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। জেল কিংবা অ্যাক্রিলিক ম্যানিকিউর কিছুদিন বন্ধ রাখুন।
৬. ভিটামিন, খনিজ, ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন; নিয়মিত মাছ, ডিম, চর্বিহীন মাংস, বাদাম, সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল খান।
*ডা. নওসাবাহ্ নূর: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, পপুলার মেডিকেল কলেজ