কুর্মিটোলা হাসপাতালে কেন এই সেবিকাকে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ডাকা হতো

৪০ বছরের নার্সিং জীবনে খুব কম দিনই ছুটি নিয়েছেন। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সহকর্মীরা তাঁকে ডাকতেন ‘কুর্মিটোলার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল’। করোনাকালে সাহসিকতার জন্য দেশ–বিদেশ থেকে পেয়েছেন নানা পুরস্কার। অবসরে গিয়েও যুক্ত আছেন নার্স গড়ার কাজে। তেরেসা বাড়ৈর গল্প শোনাচ্ছেন কবীর হোসাইন

তেরেসা বাড়ৈ

শৈশবেই বাবাকে হারান তেরেসা বাড়ৈ। তারপর শুরু হয় তাঁর হোস্টেলজীবন। কুষ্টিয়ার একটি মিশনারি হোস্টেলে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পড়াশোনায় কেবল ক্লাসসেরা ছিলেন না; নাচ, গান, আবৃত্তি কিংবা খেলাধুলা—সবকিছুতে ছিলেন দুর্দান্ত।

স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হবেন, মানুষের সেবা করবেন। কিন্তু টানাপোড়েনের জীবনে একসময় উচ্চমাধ্যমিক শেষ করাই দায় হয়ে ওঠে। তাই ভাবলেন, পড়াশোনার পাট চুকিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকতার পেশায় ঢুকে যাবেন। তবে এ সিদ্ধান্তে মন খুব একটা সায় দিচ্ছিল না। নিজ হাতে সেবা দিয়ে রোগীকে সারিয়ে তুলব—এমন একটা স্বপ্নের বৃত্তে ঢুকে পড়েছে যাঁর মন, অন্য কোনো পেশা যে তাঁকে টানবে না, এটাই তো স্বাভাবিক। তখন মিশনারির সিস্টার তাঁকে নার্সিংয়ে ভর্তির পরামর্শ দিলেন। আর কোনো দ্বিধা থাকল না। ঠিক করলেন, নার্সই হবেন। তাতে স্বপ্নের গতিপথ বদলাল তবে স্বপ্নটা বেঁচে রইল।

সেরা নার্সের সম্মাননা গ্রহণ করছেন তেরেসা বাড়ৈ

যে জীবন সেবা-শুশ্রূষার 

১৯৭৯ সালে মাধ্যমিক পাস করে বরিশাল মেডিকেল কলেজে নার্সিংয়ে ভর্তি হন তেরেসা বাড়ৈ। ১৯৮৪ সালের জুনে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর আনুষ্ঠানিক পেশাজীবন। পাশাপাশি সিলেটের এমসি কলেজে ভর্তি হয়ে যান। পূর্ণ মনোযোগে হাসপাতালের ডিউটির পাশাপাশি চলে উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনা ও পরীক্ষা। ঢাকায় বদলি হয়ে এসে প্রাইভেটে বিএ–তেও ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে বিএসসি ইন নার্সিংয়ের পরীক্ষা পড়ে যাওয়ায় বিএ পরীক্ষাটা আর দেওয়া হয়নি। এভাবে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। পড়াশোনার কারণে পেশাগত দায়িত্ব পালন বাধাগ্রস্ত হয়নি? জবাবে বলেন, ‘একদমই না। কেননা, দায়িত্বটা ছিল আমার প্রথম অগ্রাধিকার। আর পড়াশোনা যা করেছি, তা তো কর্মক্ষেত্রে আমার যোগ্যতা বাড়ানোর জন্যই। নার্সিং ব্যাপারটাকে আমি কেবল সীমাবদ্ধ কিছু নির্দিষ্ট কাজের মধ্যে আটকে রাখতে চাইনি। প্রতিদিনই নতুন কিছু শিখতে চেয়েছি।’

করোনার সময় বসুন্ধরার আইসোলেশন সেন্টারে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সেবা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন

করোনাকালে এক সেবিকা

২০২০ সালে দেশে যখন কোভিড সংক্রমণ শুরু হয়, তেরেসা বাড়ৈ তখন রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নার্স সুপারিনটেনডেন্ট। সে এক অদ্ভুত, ভয়ংকর ও অমানবিক পরিস্থিতি। ভীত, দ্বিধান্বিত অন্য নার্সদের বলার আগে নিজে রোগীর কাছে গেলেন, সেবা দিলেন। তাঁর সাহসে উদ্বুদ্ধ হলেন অন্যরা।

করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিস্তৃত পরিসরে সেবা দিতে অস্থায়ীভাবে বসুন্ধরার আইসোলেশন সেন্টার চালু হলে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সেখানে সেবা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর থেকে তাঁর দিন–রাত যেন একাকার হয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। বেলা দুইটা পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করে সোয়া দুইটা বা আড়াইটার মধ্যে চলে যান বসুন্ধরা আইসোলেশন সেন্টারে। সেখানে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কাজ করে রাত আটটার পরে বাসায় যান। তেরেসা বলেন, ‘তখন আসলে নির্দিষ্ট ডিউটি টাইম বলে কোনো ব্যাপার ছিল না। ২৪ ঘণ্টাই অন ডিউটি।’

ইউনিক নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন

চাকরিতে অবসর আছে, দায়িত্বে নেই

২০২২ সালের জুনে পেশাগত জীবন থেকে আনুষ্ঠানিক অবসর নিয়েছেন তেরেসা বাড়ৈ, ‘চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। কিন্তু দায়িত্বের তো আর অবসর হয় না।’

তাই তো নতুন প্রজন্মকে নার্সিং পেশায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে কাজ করে চলেছেন। বর্তমানে ঢাকার অদূরে ইউনিক নার্সিং কলেজ নামে একটি বেসরকারি নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে নানা পুরস্কার পেয়েছেন তেরেসা বাড়ৈ। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেবা করে পেয়েছেন থাইল্যান্ডের এশিয়া প্যাসিফিক অ্যাকশন অ্যালায়েন্স অন হিউম্যান রিসোর্স ফর হেলথের (এএএএইচ) সম্মাননা, রোটারি ইন্টারন্যাশনালের ‘কোভিড-১৯ হিরো অ্যাওয়ার্ডস’। 

তেরেসা বাড়ৈর জন্ম ১৯৬৩ সালে গোপালগঞ্জের বানিয়ারচরে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সহকর্মীরা তাঁকে ডাকতেন ‘কুর্মিটোলার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল’ বলে। তাঁর কাছে মানুষের ভালোবাসা মেশানো এই উপাধিকে মনে হয় সব পুরস্কারের চেয়ে বড় পুরস্কার।

 ২০২০ সালে দেশে যখন কোভিড সংক্রমণ শুরু হয়, তেরেসা বাড়ৈ তখন কুর্মিটোলা হাসপাতালের নার্স সুপারিনটেনডেন্ট। অন্য নার্সদের বলার আগে নিজে করোনা রোগীদের সেবা দিলেন। তাঁর সাহসে উদ্বুদ্ধ হলেন অন্যরা