জেনে নিন ফ্যাটি লিভারে কী খাবেন, কী খাবেন না

ফ্যাটি লিভার বর্তমান বিশ্বের একটি বড় সমস্যা। অনেকে অল্প বয়সেই আক্রান্ত হচ্ছেন ফ্যাটি লিভারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ফলে হতে থাকে যকৃতে প্রদাহ, আর ক্রমাগত প্রদাহ থেকে পরবর্তী সময়ে সিরোসিস বা ক্যানসার হওয়াও বিচিত্র নয়। এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে হেপাটাইটিস ভাইরাসজনিত লিভার সিরোসিসকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছে ফ্যাটি লিভারজনিত সিরোসিস। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, অদূর ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে যাচ্ছে ফ্যাটি লিভার।

আমাদের দেশে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজই বেশি দেখা যায়। এর প্রধান কারণ স্থূলতা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও কায়িক শ্রমের অভাব। এই ফ্যাটি লিভারের আদতে কোনো চিকিৎসা নেই, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ছাড়া। ওজন কমানো, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়ামই পারে একমাত্র এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে। তাহলে জেনে নিন ফ্যাটি লিভার হলে কী কী খাবেন আর কী কী খাবেন না।

কী খাবেন

সেদ্ধ করে পানি না ফেলে বা সম্ভব হলে কাঁচা সালাদে যতটা সম্ভব সবুজ পাতাওয়ালা সবজি খাওয়ার চেষ্টা করুন

সবুজ শাকসবজি: গবেষণা বলছে, সবুজ পাতাওয়ালা শাকসবজির মধ্যে যে পলিফেনল ও নাইট্রেট পাওয়া যায়, তা যকৃতের চর্বি কমাতে সাহায্য করে। তবে রান্না ও সেদ্ধ করে ফেললে এর পলিফেনলের পরিমাণ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের কার্যকারিতা অনেকটাই কমে যায়। তাই সেদ্ধ করে পানি না ফেলে বা সম্ভব হলে কাঁচা সালাদে যতটা সম্ভব সবুজ পাতাওয়ালা সবজি, যেমন শাক, লেটুস ও অন্যান্য পাতা খেতে চেষ্টা করুন।

ডাল ও বীজজাতীয় খাবার: ডাল, ছোলা, মটরশুঁটি ইত্যাদি খাবারে স্টার্চ ও আঁশ প্রচুর। এসব খাবার পরিপাকতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর, একই সঙ্গে ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সাহায্য করে। সয়াপ্রোটিন ও টফুও উপকারী। সয়াতে যে বিটা কনগ্লাইসিন থাকে, তা ট্রাইগ্লিসারাইড ও ভিসেরাল ফ্যাট কমায়। সূর্যমুখীর বীজে আছে প্রচুর ভিটামিন ই, যা ফ্যাটি লিভারের জন্য ভালো।

সামুদ্রিক মাছ: ইলিশ, রূপচাঁদা, টুনা, স্যামন, সার্ডিন ইত্যাদি ওমেগা ৩ তেলযুক্ত সামুদ্রিক মাছ উপকারি এইচডিএল কোলেস্টেরল বাড়ায় এবং ক্ষতিকর ট্রাইগ্লিসারাইড কমিয়ে যকৃতে চর্বি ও প্রদাহ কমায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সপ্তাহে অন্তত তিন দিন মাছ খাওয়া উচিত।

ওটস ও জটিল শর্করা: ফ্যাটি লিভার থেকে রেহাই পেতে আপনাকে জটিল শর্করা, যেমন ওটমিল বা লাল আটার বা যবের রুটি খেতে হবে।

বাদাম: নানা ধরনের বাদাম রাখুন প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়। বাদাম ইনসুলিন রেজিসট্যান্স কমায়, প্রদাহ ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। চার-পাঁচটা আখরোট, কাজুবাদাম হতে পারে আপনার রোজকার বৈকালিক নাশতা।

মসলা: কাঁচা হলুদের কারকিউমিন ও কাঁচা রসুন যকৃতের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

যে ছয়টি খাবার খাবেন না

ফ্যাটি লিভারের সবচেয়ে বড় শত্রু চিনি

চিনি: ফ্যাটি লিভারের সবচেয়ে বড় শত্রু কিন্তু চিনি বা শর্করা, ফ্যাট নয়। সাদা চিনি এবং চিনিযুক্ত যেকোনো খাবার, ডেজার্ট, জুস বা পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। বাড়তি চিনিই ট্রাইগ্লিসারাইড হিসেবে যকৃতে জমা হয়।

ভাজাপোড়া খাবার: উচ্চ তাপমাত্রায় ভাজা যেকোনো খাবার এড়িয়ে চলুন। চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, যেকোনো ফাস্ট ফুড আপনার জন্য নিষেধ।

লবণ: দৈনিক ২ হাজার ৩০০ মিলিগ্রামের বেশি লবণ খাওয়া যাবে না। এর মানে রান্নায় যে লবণ ব্যবহৃত হয় এর বাইরে যেকোনো লবণ, লবণযুক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার নিষেধ।

সহজ শর্করা: সাদা ভাত, ময়দার তৈরি পাউরুটি ও পরোটা, নান, নুডলস, পাস্তা ইত্যাদি যকৃতে চর্বি বাড়াবে। এর পরিবর্তে বেছে নিন লাল আটার রুটি, ব্রাউন ব্রেড বা লাল চাল, তা-ও পরিমিত পরিমাণে।

রেড মিট: রেড মিট, যেমন গরু বা খাসির মাংস খাওয়া কমিয়ে ফেলুন। মাসে এক বা দুই দিন দু-তিন টুকরা চর্বি ছাড়ানো মাংস খেতে পারেন। এর সম্পৃক্ত চর্বি আপনার জন্য ক্ষতিকর।

অ্যালকোহল: অ্যালকোহল যকৃতের শত্রু। তাই যেকোনো ধরনের অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন ফ্যাটি লিভার হলে।

ফ্যাটি লিভারের জন্য একটি আদর্শ খাদ্যতালিকা

সপ্তাহে অন্তত তিন দিন মাছ খাওয়া উচিত

সকালের নাশতা: এক বাটি ওটস বা দুটি লাল আটার রুটি বা ব্রাউন ব্রেড (পিনাট বাটার দিয়ে খেতে পারেন), এক চামচ চিয়া সিড, যেকোনো একটা ফল, এক কাপ কফি বা গ্রিন টি।

দুপুরের খাবার: মাঝারি আকারের এক বা দুই পিস মাছ বা মুরগির মাংস দিয়ে এক কাপ লাল চালের ভাত, সবুজ পাতাওয়ালা সবজি সেদ্ধ বা সালাদ (অলিভ অয়েল ড্রেসিং দিয়ে নিতে পারেন), ডাল।

বিকেলের নাশতা: একটা আপেল অথবা পাঁচ-ছয়টা কাজুবাদাম বা আখরোট।

রাতের খাবার: বিনস, ব্রকলি, শসা, টমেটো ইত্যাদি দিয়ে এক বাটি সালাদ, এক কাপ টক দই।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা