বেশ কিছুদিন আগে ‘গুগল ডাক্তার’ নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। মূলত বিভিন্ন রোগের লক্ষণ লিখে গুগলে সার্চ দিয়ে নিজে নিজে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টাকেই ‘গুগল ডাক্তার’ বলে অভিহিত করা হতো। বহু মানুষ গুগলের প্রেসক্রিপশন দেখে এমনকি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের লেখা প্রেসক্রিপশনকেও চ্যালেঞ্জ করে বসতেন। এমবিবিএস ডিগ্রির চেয়ে গুগল হয়ে উঠত তাদের বিশেষ ভরসার জায়গা।
গত বেশ কিছু বছর এর ফলে ঘটে যাওয়া কিছু দুর্ঘটনা, সেগুলো নিয়ে ধারাবাহিক লেখালেখি ও সচেতনতার ফলে গুগল চিকিৎসকের উৎপাত এখন অনেকটাই কমেছে। তবে সেটা ‘কাস্টমাইজ’ হয়ে শুরু হয়েছে নতুন ট্রেন্ড—ফেসবুকে ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যার সমাধান খোঁজা।
শুরুতে বিনোদন ও সামাজিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক হয়ে ওঠে নানা ধরনের সামাজিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বিশাল এক কেন্দ্রবিন্দু। গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন গ্রুপ ও কমিউনিটি, যার মধ্যে বই পড়া, রক্তদানের মতো অসাধারণ সামাজিক গ্রুপ যেমন আছে, তেমনি আছে মানসিক সমস্যা, আইনি সমস্যা ও ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানের বিভিন্ন গ্রুপও।
অনেক ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সমাধানের রাস্তাও মেলে। বিয়ের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে মাঝেমধ্যে অনেকেই পোস্ট দেন যে তাঁরা সেই গ্রুপ থেকে নিজেদের জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছেন। তবে আপনি যদি প্রশ্ন করেন, ফেসবুকের গ্রুপ থেকে সত্যিই কি ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়? এর কোনো সরল উত্তর নেই। অর্থাৎ, কিছু সমস্যার সমাধান মেলে, কিছু মেলে না, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনলাইনের সেসব পরামর্শ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে। দুই পক্ষেরই যুক্তি আছে। জেনে নেওয়া যাক সেগুলো।
কেন অনলাইনে সমস্যার সমাধান খুঁজবেন?
অনলাইনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, খুব সহজেই অনেক বড় ‘অডিয়েন্সের’ কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়।
আপনি হয়তো ব্যক্তিজীবনে আপনার সমস্যা নিয়ে খুব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবেন না। অনলাইনে যেসব গ্রুপ গড়ে উঠেছে, সেখানে ওই বিষয়ের অনেক বিশেষজ্ঞও যুক্ত থাকেন। হয়তো ১০০টা মন্তব্যের ৯৭টা কোনো কাজের নয়, তবে এ রকম ৩টা মন্তব্যও থাকে, যেগুলো আপনি বিবেচনায় নিতে পারেন। দুই–একটা আপনার কাজেও লেগে যেতে পারে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, আপনি যে সমস্যায় পড়েছেন, একই ধরনের সমস্যায় আগে পড়েছেন, এমন মানুষেরা নিজেদের অভিজ্ঞতা আপনার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিলে আপনার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হয়ে যায়।
অনেক অনেক পরামর্শ থেকে আপনার জন্য কোনটা প্রযোজ্য, সেটা খুঁজে নেওয়ার দায়িত্ব আপনার।
আইন, শিশু প্রতিপালন, গর্ভাবস্থা, পুরোনো জামাকাপড় বা যেকোনো কিছু বিক্রি, বিয়ে, মানসিক সমস্যা, প্রেমের সম্পর্কে জটিলতা, পশু-পাখি পালন, গাছের যত্ন, গেম খেলা ইত্যাদি নানা বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার নির্ভরশীল অনেক গ্রুপ আছে। আপনাকে যে গ্রুপ আগ্রহী করে তোলে, আপনি আপনার সমমনা মানুষদের সহজেই সেখানে পেয়ে যাবেন।
অনলাইনে নিজের পরিচয় গোপন করে সমস্যার কথা জানানো যায়। সেটাও অনলাইনে ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান খোঁজাটাকে জনপ্রিয় করেছে।
কেন অনলাইনে সমস্যার সমাধান খুঁজবেন না?
সেদিন এক মেয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, কোনো এক গার্লস গ্রুপের পরামর্শ অনুযায়ী আচরণ করতে গিয়ে সঙ্গীর সঙ্গে তাঁর ভয়াবহ সমস্যা তৈরি হয়েছে। এমনকি তাঁদের বহুদিনের সম্পর্ক খুব বাজেভাবে ভেঙে গেছে। তিনি এখন অনুতপ্ত, ফেসবুক গ্রুপের সেই পরামর্শে কান না দিলে হয়তো তাঁর এত দিনের সম্পর্কটার পরিণতি এমন হতো না। এমন ঘটনা কিন্তু একটা নয়, বহু। এমনকি সঙ্গী নির্ধারণ, ক্যারিয়ার পরিকল্পনা, বিয়ে বা পরিবার পরিকল্পনার মতো অতি ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও বহু মানুষ প্রশ্ন করে বসেন। ভাবুন তো, একদল অজানা, অচেনা মানুষ, যাঁরা আপনাকে চেনেন না, আপনার পরিস্থিতি পুরোটা জানেন না, তাঁরা কীভাবে আপনার ভালো–খারাপের রায় দেবেন?
আবার, একজন মানুষ একটা কাজ করে খারাপ অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন বা ব্যর্থ হয়েছেন বলে আপনিও যে ব্যর্থ হবেন, এ কথাই বা কে বলেছে? কাজেই, আপনি যখন ফেসবুকে মানুষের মতামত দেখে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যান, তখন মানুষের ব্যর্থতাকেই মূলত আপনি নিজের ঘাড়ে তুলে নেন। বন্ধ করে দেন নিজের সফলতার রাস্তাটাও।
অনেক ক্ষেত্রেই এসব গ্রুপে সমস্যার সমাধান চেয়ে অনেকে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্য ও ব্যক্তিগত আক্রমণের সম্মুখীন হন। ব্যঙ্গ–বিদ্রুপের শিকার হতে হয়, এমনকি অনেক সময় সমাধানের কথা বলে প্রতারণার খপ্পরে পর্যন্ত পড়তে হয়। আর গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে ব্যক্তিগত সমস্যা ভাইরাল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তো আছেই।
একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, ক্যারিয়ার, বিয়ে বা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কথার ওপর ভিত্তি করে নেওয়া আর অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। আপনার জ্বর হলে বা মাথাব্যথা হলে যেমন আপনি ফেসবুকে না এসে চিকিৎসকের কাছে যান, তেমনি আপনার মানসিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার জন্যও পেশাদার সাহায্য নেওয়া উচিত। তবে আমাদের দেশে এখনো ব্যক্তিগত সমস্যা বা ক্যারিয়ার–সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার মতো যথেষ্ট পেশাদার লোক যেহেতু নেই, তাই পরিবারের অভিজ্ঞ কোনো সদস্য বা কাছের কোনো বড় ভাই বা বোন কিংবা আপনার পছন্দের কোনো শিক্ষককেও আপনি পরামর্শ নেওয়ার জন্য বাছাই করতে পারেন। পরামর্শ নেওয়ার সময় এমন কারও কাছ থেকে নিতে হবে, যিনি আপনার পরিস্থিতি বুঝতে সক্ষম আর ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।