আমাদের দেশে বছরের অধিকাংশ সময়ই উষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে বলে গরম আবহাওয়ার জন্য যতটা প্রস্তুতি থাকে, তীব্র শীত বা ঠান্ডার প্রস্তুতি তেমন কারও থাকে না। তবে এ বছর তাপমাত্রা হঠাৎ অনেকটা কমে গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে শৈত্যপ্রবাহ। আমাদের দেশের বাড়িগুলোয় হিটিং সিস্টেম নেই, থাকার কথাও নয়। তা ছাড়া তীব্র ঠান্ডায় কী ধরনের জটিলতা বা সমস্যা হতে পারে, সে বিষয়ে আমাদের ধারণাও কম।
অস্বাভাবিক কম তাপমাত্রায় যেসব জটিলতা হতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম ফ্রস্ট বাইট। ফ্রস্ট বাইট শব্দটি আমাদের কাছে খুব পরিচিত নয়। বাংলায় এটিকে অনেকে তুষারক্ষত বলেন, আবার শীতদংশন নামেও অভিহিত করা যায়। তবে যাঁরা পর্বতারোহণের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের কাছে এটি বেশ পরিচিত শব্দ। ফ্রস্ট বাইট হচ্ছে অস্বাভাবিক কম তাপমাত্রার কারণে শরীরের উন্মুক্ত অংশে তৈরি হওয়া ক্ষত বা আঘাত। সাধারণত দীর্ঘ সময়ের জন্য কম তাপমাত্রায় উন্মুক্ত থাকলে হাত, পা বা মুখের নানা অংশে এটি হতে পারে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যাঁরা দীর্ঘ সময় বাইরে কম তাপমাত্রার পরিবেশে অবস্থান করেন, যেমন পর্বতারোহী, শীতকালীন ক্রীড়াবিদ অথবা বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ, তাঁদের ফ্রস্ট বাইট বেশি হতে পারে। তবে যাঁদের ডায়াবেটিস বা হাইপোথাইরয়েডিজম আছে, যাঁরা মদ্যপায়ী বা ধূমপায়ী অথবা আগে থেকেই যাঁদের ত্বকে ক্ষত বা অক্সিজেন সরবরাহে কমতি আছে, পানিশূন্যতা আছে, তাঁরা ফ্রস্ট বাইটে আক্রান্ত হন বেশি।
ফ্রস্ট বাইটের সাধারণ উপসর্গগুলোর মধ্যে আছে প্রথমেই ত্বকে খোঁচা ভাব বা চুলকানি, অসাড় ভাব, ত্বকের রং পরিবর্তন, পরে ত্বকে ফোসকা পড়া। ফ্রস্ট বাইটের মোট চারটি পর্যায় রয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে ত্বকের উপরিভাগ অসাড় হয়, ঠান্ডা হয় এবং ব্যথা থাকতে পারে। এতে ত্বক সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ফোসকা পড়ে ত্বক কালচে বর্ণ ধারণ করতে পারে। ত্বক শক্ত হয়ে যায়, ওপরের চামড়া উঠে যেতে থাকে।
তৃতীয় পর্যায়ে গেলে এটি আরও গভীরে বিস্তার লাভ করে, এতে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর সঙ্গে গভীর ক্ষত বা আলসার থাকতে পারে। হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা।
চতুর্থ পর্যায়ে এটি আরও গভীরে যায়, হাড়, পেশি বা গভীর রক্তবাহী ধমনিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে আক্রান্ত স্থান কালো হয়ে অকেজো হয়ে যেতে পারে।
সাধারণত ফ্রস্ট বাইট নির্ণয় করা কঠিন কিছু নয়। তবে এর ব্যাপ্তি নির্ধারণ করার জন্য চিকিৎসক এক্স–রে, সিটি স্ক্যান বা এমআরআইয়ের সাহায্য নিতে পারেন।
ফ্রস্ট বাইটে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা খুব দ্রুত শুরু করা দরকার। প্রথমেই শীতল এলাকা থেকে রোগীকে সরিয়ে উষ্ণ স্থানে স্থানান্তর জরুরি। তারপর তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য গরম জলের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে, প্রয়োজনে চামড়া হালকা ঘর্ষণের মাধ্যমে তাপমাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক, রক্ত চলাচল বাড়ানোর জন্য কিছু ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। কখনো কখনো আক্রান্ত স্থান বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। তবে তাপমাত্রা বাড়ানোর উপায় হিসেবে আগুনের সেঁক না দেওয়াটাই ভালো। ফ্রস্ট বাইট বা তুষারক্ষত ত্বকের সাধারণ সমস্যা থেকে অনেক জটিল সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
দেশের অনেক স্থানেই তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচে নেমে গেছে। তাপমাত্রা যত দেখায়, তাপমাত্রার অনুভূতি তার থেকে ভিন্ন হতে পারে। যেমন ১০ ডিগ্রি দেখালেও তার অনুভূতি বা তীব্রতা ৪ বা ৫ হওয়া বিচিত্র নয়। এটা নির্ভর করে বাতাসের গতি ও আর্দ্রতার ওপর।
এ রকম নিম্ন তাপমাত্রায় নিজেকে রক্ষা করতে কী করবেন?
তীব্র শীতে যতটা সম্ভব কম সময় বাইরে অবস্থান করুন। ভোরে বা রাতে যখন তাপমাত্রা বেশি কমে যায়, তখন বাইরে বেশিক্ষণ না কাটানোই উচিত; বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুরা।
এই ঠান্ডায় বাইরে যাওয়ার সময় স্তরে স্তরে পোশাক পরুন। মানে নিচে গেঞ্জি, শার্ট, সোয়েটার ইত্যাদি কয়েক স্তর পরার পর বাইরে ভারী জ্যাকেট বা কোট পরুন। পায়ে মোজা পরুন। মাথা–কান ঢাকতে টুপি ব্যবহার করুন।
তীব্র কুয়াশায় বা ঠান্ডা পানিতে বেশিক্ষণ কাজ করবেন না। বিভিন্ন পেশাজীবী, যেমন কৃষক, জেলেদের এমনটা করার দরকার হতে পারে। তাঁরা কাজে বিরতি নিন।
বাড়িতে বারবার ঠান্ডা পানিতে কাপড় বা বাসন ধোয়ার কাজে গ্লাভস পরা ভালো। নয়তো হাতের ত্বকে ফ্রস্ট বাইট হতে পারে।
ভোরে বা সন্ধ্যার পর জানালার কাচ বন্ধ করে ভারী পর্দা দিয়ে দিলে ঠান্ডা বাতাস কম ঢুকবে।
যাঁরা ঘর গরম রাখতে হিটার ব্যবহার করেন, তাঁরা ঘরের কোণে একটা বালতি বা হাঁড়িতে পানি রাখবেন নয়তো বেশি শুষ্ক হয়ে যাবে।
ডা. শাহনূর শারমিন, সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।