‘ওয়েট লস’ ইন্টারনেটে সব সময়ের সবচেয়ে ট্রেন্ডি শব্দযুগলের একটি। ওজন কমানোর ভিডিওগুলোরও কোটি কোটি ভিউ। তবে ওজন কমানোর এসব তত্ত্ব, তথ্যে সত্যের সঙ্গে অসত্য এমনভাবে মেশানো থাকে যে আলাদা করাটাই কঠিন। চলুন ওজন কমানো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচলিত কয়েকটি মিথ সম্পর্কে জেনে নিই।
১. যত ইচ্ছা ‘সুপার ফুড’ খান
অনেক খাবার খুবই পুষ্টিকর। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় আর উপকারী। বিশেষ করে শাকসবজি এবং টকজাতীয় ফল। বলা হয়, এসব খাবার আপনি অনেক খেতে পারবেন। আর তা আপনার ওজন বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে না।
আসলে ‘সুপার ফুড’ নামে কোনো নির্দিষ্ট খাবার নেই। একটা খাবারকে তখনই সুপার ফুড বলা হয়, যখন এটি প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে। বাড়াতে পারে আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। পুষ্টিগুণ ছাড়াও যেসব খাবার একাধিক স্বাস্থ্যসুবিধা প্রদান করে। তাই এদের ‘সুপার ফুড’ ডাকা হয়। তাই বলে যত ইচ্ছা তত খেতে পারবেন না। কেননা সেটি যত পুষ্টিকরই হোক না কেন, শরীরের সেই খাবারের একটা নির্দিষ্ট চাহিদা রয়েছে। এর অতিরিক্ত খেলেই শরীরে তার একটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।
২. চর্বিজাতীয় খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর!
আপনি কোথাও কোথাও এ রকমটা পড়ে থাকবেন, দেখে থাকবেন। যেখানে ‘ফ্যাট’জাতীয় খাবার থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তবে ঢালাওভাবে এ কথা কোনোভাবেই বলা যাবে না। চর্বিজাতীয় খাবার স্বাস্থ্যের জন্য কখনো ভালো, আবার কখনো মারাত্মক খারাপ। আর সেটা নির্ভর করে কোন উৎস থেকে খাবারটি আসছে। যদি মাংসজাতীয় খাবার অর্থাৎ প্রাণিজ উৎস থেকে আসে, তবে এটাকে বলা হয় স্যাচুরেটেড ফ্যাট। আর মাছ বা গাছপালা থেকে যে চর্বি পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট।
আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরের জন্য উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি কমায়।
সহজে আনস্যাচুরেটেড চর্বি এবং স্যাচুরেটেড চর্বি চিনতে চান? কক্ষ তাপমাত্রায় যদি যে চর্বি জমাট বাঁধে, তা স্যাচুরেটেড চর্বি। আর কক্ষ তাপমাত্রায় যা তরল অবস্থায় থাকে, তা আনস্যাচুরেটেড চর্বি। তবে ব্যতিক্রম—নারকেল তেল। এই তেলের ৯২ শতাংশই স্যাচুরেটেড ফ্যাট। এতে বিদ্যমান কোলেস্টেরলের মাত্রা অন্যান্য প্রাণিজ চর্বির মতোই।
৩. ‘প্রাকৃতিক চিনি’ ভালো
আমরা যে সাদা চিনি খাই, তা প্রধানত সুক্রোজ। এটি গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ দ্বারা তৈরি। আবার মধু, মেপল সিরাপ, আখের চিনি, গুড়— এদেরকে অনেক সময় প্রাকৃতিক চিনি আখ্যা দিয়ে বলা হয়, এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কখনো কখনো এগুলোকে ‘চিনির বিকল্প’ হিসেবে তুলে ধরা হয়। এটি সম্পূর্ণ ভুল। ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে এরা তৈরি হয় বলে এদের স্বাদে কিছু ভিন্নতা থাকে। তবে মধু, আখের চিনি বা মেপল সিরাপের মিষ্টত্বের কারণ গ্লুকোজ এবং ফ্রুকটোজই। অন্য কিছু নয়। তবে এগুলো অনেক সময় কম ‘রিফাইন্ড’ হওয়ায় সাদা চিনি থেকে সামান্য কম ক্ষতিকর!
৪. শরীরকে ডিটক্স (দূষণমুক্ত) করবে অমুক পানীয়!
বলা হয়ে থাকে, ডিটক্স পানি আমাদের শরীরের দূষিত পদার্থ বের করতে সাহায্য করে, মেটাবলিজম বা বিপাকপ্রক্রিয়া বাড়ায়, সেই সঙ্গে ওজনও কমায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ক্রল করলেই নানা ধরনের ডিটক্স সাপ্লিমেন্টের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। পানির সঙ্গে বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট মিশিয়ে ডিটক্স ওয়াটার বানানো হয়। এসব পানীয় আমাদের শরীরের জন্যে মোটেও ভালো নয়। শরীরকে দূষণমুক্ত করতে আমাদের নিজস্ব সিস্টেম রয়েছে। লিভার এবং কিডনি দক্ষতার সঙ্গে শরীর থেকে সব দূষিত ও বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়। তাই কোনো ধরনের সাপ্লিমেন্ট বা ওষুধ খাবার পরিবর্তে পানি পান করুন। তবে আদা, লেবু বা শসা এসব দিয়ে ঘরে ডিটক্স পানীয় আপনি বানাতেই পারেন। এসবে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
৫. কার্বোহাইড্রেট খাবেন না
কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় খাবার আমাদের শরীরে শক্তি জোগায়। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। তাই ওজন কমাতে চাইলে কোনোভাবেই শর্করাজাতীয় খাবার পুরোপুরি বাদ দেওয়া যাবে না। তাতে শরীর দুর্বল হয়ে যায়। কাজ করার শক্তি পাবেন না। শর্করাজাতীয় খাবার আপনি কতটা খাবেন, সেটা নির্ভর করে আপনার জীবনযাপন পদ্ধতির ওপর। যদি আপনি নিয়মিত কায়িক শ্রম করেন, তাহলে আপনাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ শর্করাজাতীয় খাবার খেতেই হবে। তবে ওজন কমাতে চাইলে খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে পারেন সাদা রুটি, সাদা ভাত বা চিনিযুক্ত খাবার। তার পরিবর্তে যোগ করুন লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি, গোটা শস্য (হোল গ্রেইন), শাকসবজি, ফল—এ–জাতীয় জটিল শর্করা। জটিল শর্করা হজম হতে সময় লাগে। ফলে অনেক বেশি সময় ধরে পেট ভর্তি থাকে। তাই ক্ষুধা কম লাগে।
বুঝতেই পারছেন, এসব পরামর্শের কোনটিই সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। আপনার জন্য কতটুকু প্রযোজ্য সেটি নির্ভর করে আপনার শারীরিক অবস্থা, জীবনযাপন পদ্ধতিসহ আরও নানাকিছুর ওপর। উল্টো এই মিথগুলো আপনার ওজন কমানোর যাত্রায় জটিলতা বাড়াতে পারে।
সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, অনলি মাই হেলথ