ছোট-বড় সবারই কমবেশি নখ কামড়ানো বদভ্যাস আছে। অবচেতনে অনেকেই এটি করে থাকে। নখ কামড়ানোর বদভ্যাস কখনো কখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ইচ্ছা করলেও আর বাদ দেওয়া যায় না। নখ কামড়ানোর কারণে অনেক সময় বাচ্চাকে বাবা–মায়েরা বকাঝকা করেন। তারপরও কোনো লাভ হয় না। কোনো কাজে ব্যস্ত থাকলে বা সামাজিকভাবে তিরস্কার করলে নখ কামড়ানো অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ থাকে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে আবার দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে নখ কামড়ানোর অভ্যাস নখ ও মুখের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
নখ কামড়ানো কি কোনো রোগ
কদাচিৎ একবার বা দুবার নখ কামড়ানো কোনো রোগ না। কমবেশি অনেকের মধ্যে এটা থাকে। কিন্তু তখনই এটি অসুস্থতার পর্যায়ে পড়বে, যখন বারবার কেউ নখ কামড়াতে থাকে, যা ওই ব্যক্তি কমাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং কর্মক্ষেত্রে, ব্যক্তিজীবনে বা পারিবারিক জীবনে সমস্যা তৈরি করে। এটিকে তখন একধরনের মানসিক সমস্যা বলা যায়। নখ কামড়ানোর এই সমস্যাকে বলে ওনাইকোফেজিয়া (Onychophagia)।
নখ কামড়ানো কাদের সমস্যা
যেকোনো বয়সে নখ কামড়ানোর বদভ্যাস থাকতে পারে। তবে বয়সভিত্তিক ভিন্নতা দেখা যায়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১০ বছর বয়সে এবং বয়ঃসন্ধিকালে নখ কামড়ানোর হার যথাক্রমে ৩৩ ও ৪৫ শতাংশ। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মধ্যে বেশি নখ কামড়ানোর অভ্যাস দেখা যায়।
নখ কামড়ানোর কারণ
নখ কামড়ানো মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। কর্মহীন অলস সময় যে কেউ নখ কামড়াতে পারে। এটা কোনো মানসিক রোগ নয়। পা দোলানো বা বারবার চুল স্পর্শ করার মতো এটি একটি উদ্দেশ্যহীন আচরণ। কিন্তু অনেক মানসিক রোগ আছে যেমন বিষণ্নতা, মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ওসিডি, স্টেরিওটাইপ মুভমেন্ট ডিজঅর্ডারে নখ কামড়ানোর মতো উপসর্গ দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে নখ কামড়ালে অনেকের মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা কমে যায়।
একঘেয়েমি বা অবসাদ অনেক সময় নখ কামড়ানো বাড়িয়ে দেয়। যাঁরা খুঁতখুঁতে ব্যক্তিত্বের অধিকারী, সবকিছুতেই নির্ভুল হতে চান, তাঁদের মধ্যে নখ কামড়ানোর বদভ্যাস লক্ষিত হয়। জিনগত কারণেও নখ কামড়ানোর অভ্যাস দেখা যায়। মা-বাবা বা ভাইবোনের মধ্যে নখ কামড়ানোর অভ্যাস থাকলে অনেক সময় এই অভ্যাস হতে পারে।
বিভিন্ন মানসিক রোগেও নখ কামড়ানোর বদভ্যাস লক্ষ করা যায়। যেমন শিশুদের অতি চঞ্চলতা রোগ (এডিএইচডি), অবাধ্যতা রোগ (ওডিডি), বিচ্ছেদজনিত উদ্বেগ রোগ, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, অটিজম, টরিটিস সিনড্রোম ইত্যাদি।
নখ কামড়ানোর ক্ষতিকর দিক
১. নখের সৌন্দর্য ও আকৃতি নষ্ট হয়।
২. নখের গোড়ায় ইনফেকশন হয়ে পুঁজ হতে পারে।
৩. নখের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং বিকৃত নখ ওঠে।
৪. নখের পাশের চামড়া লাল হয়ে ব্যথা করতে পারে।
৫. নখের সংক্রমণ মুখে যেতে পারে।
৬. আত্মমর্যাদা কমে যায়। সামাজিকভাবে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
৭. লজ্জা ও বিষণ্নতা গ্রাস করে।
নখ কামড়ানো যেভাবে বন্ধ করবেন
১. মৃদু বা স্বল্প মাত্রায় নখ কামড়ালে এবং নখের কোনো ক্ষতি বা ইনফেকশন না হলে কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। শুধু ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
২. নিয়মিত নখের পরিচর্যা করতে হবে, নখ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ছোট রাখতে হবে।
৩. অতিরিক্ত নখ কামড়ানো কমাতে হাতে গ্লাভস পরে থাকলে কিছুটা কমে আসে।
৪. তিতা স্বাদযুক্ত নেইল পলিশ বা হোয়াইট ভিনেগার বা আপেল সাইডার নখে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫. অতিরিক্ত মানসিক চাপ কমাতে হবে এবং দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে হবে। প্রয়োজনে সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং করাতে হবে। প্রতিদিন রাতে ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম এবং বিকেলে হালকা ব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
৬. হ্যাবিট রিভার্সাল টেকনিক নামে একটি আচরণগত থেরাপি আছে, যা বারবার নখ কামড়ানো কমাতে সহায়ক।
৭. মানসিক রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে।
নখ কামড়ানো শিশু-কিশোর বা বয়স্ক মানুষের জীবনে শারীরিক, মানসিক, সামাজিকসহ বিভিন্নভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই যেকোনো বয়সের নখ কামড়ানোকে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসা নিন এবং সুস্থ থাকুন।
ডা. মো. রশিদুল হক: সহযোগী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।