ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি বিপাকীয় রোগ। ডায়াবেটিস হলে রক্তের শর্করা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। আমরা যখন যে খাবার খাই, তা ভেঙে গিয়ে গ্লুকোজে (সুগার) পরিণত হয় এবং অগ্ন্যাশয় থেকে আসা ইনসুলিন রক্তের এই গ্লুকোজকে কোষের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দেহে শক্তির জোগান দেয়। যখন অগ্ন্যাশয় থেকে পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি হয় না কিংবা ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, তখন অতিরিক্ত গ্লুকোজ রক্তে থেকে যায় এবং তা বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিস তৈরি হয়। ডায়াবেটিসের কারণে ধীরে ধীরে হৃৎপিণ্ড, কিডনি, চোখ, স্নায়ু ও রক্তনালির মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
ডায়াবেটিস নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। কয়েকটি ভুল ধারণা নিয়ে কথা বলা যাক।
১. ডায়াবেটিস শুধু বড়দের হয়
ডায়াবেটিস দুই রকমের হতে পারে। টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ -১ ডায়াবেটিস সাধারণত অল্প বয়সে বা ৩০ বছরের আগে হয়। অন্যদিকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস সাধারণত বয়স ৪০-এর পরে হয়। তার মানে ডায়াবেটিস কেবল বুড়োদের রোগ নয়।
২. মিষ্টি খাবার বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয়
টাইপ-১ ডায়াবেটিস খাবার বা জীবনযাত্রার ধরনের কারণে হয় না। বরং আমাদের দেহের অগ্ন্যাশয়ে থাকা ইনসুলিন তৈরি করে, এমন বিটা কোষগুলো যখন অকার্যকর হয়ে যায় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি হতে পারে না, তখন টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয়। অন্যদিকে অতিরিক্ত ওজন ও শারীরিক পরিশ্রম না করা—মূলত এই দুটি কারণে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। মিষ্টি খাবারের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। তবে মিষ্টিজাতীয় খাবার উচ্চ ক্যালরিযুক্ত, যা ওজন বৃদ্ধির জন্য দায়ী। আর ওজন বাড়লে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়ে।
৩. ডায়াবেটিস হলে ফল খাওয়া যাবে না
ফল একটি স্বাস্থ্যকর খাবার। কেক, বিস্কুট ও মিষ্টির চাইতেও কম চিনি থাকে ফলের মধ্যে। এ ছাড়া ফলে অন্যান্য পুষ্টি উপাদান ও আঁশ রয়েছে। যেসব ফল ডায়াবেটিক রোগীরা খেতে পারবেন, তার মধ্যে আছে আপেল, নাশপাতি, আভোকেডো, পেঁপে, শসা, পেয়ারা, লেবু, তরমুজ, আঙুর, টমেটো, স্ট্রবেরি, কালোজাম ইত্যাদি।
৪. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চলে এলে আর ওষুধ খাওয়া লাগে না
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কিন্তু পুরোপুরি সেরে যায় না। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত এমন কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি, যা ডায়াবেটিসকে পুরোপুরি নিরাময় করতে পারে। তাই স্বাস্থ্যকর খাবার ও ব্যায়ামের পাশাপাশি ডায়াবেটিসের ওষুধ সব সময় খেয়ে যেতে হবে।
৫. শুধু ওষুধ বা ইনসুলিন নিলেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রধানত ৩টি চিকিৎসা লাগে—১. সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ২. নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন সপ্তাহে ১৫০ মিনিট হাঁটাহাঁটি এবং ৩. খাবার ওষুধ বা ইনসুলিন গ্রহণ করা। হাঁটাহাঁটি করলে শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, ওজন কমে, ডায়াবেটিস ও হৃদ্রোগজনিত জটিলতা কমে। তাই কার্যকরভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার জন্য খাবারে পরিবর্তন, ব্যায়াম ও ওষুধ গ্রহণ—সবকিছুই মেনে চলতে হবে। যেকোনো একটি করলে হবে না।
৬. প্রিডায়াবেটিস থাকলে কোনো ভয় নেই
যাদের রক্তে সুগার লেভেল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, কিন্তু ডায়াবেটিক রেঞ্জের চেয়ে কম আছে, তাদের প্রিডায়াবেটিক মানুষ বলে। প্রিডায়াবেটিক মানুষেরা আগামী ১০ বছরের মধ্যে ডায়াবেটিস হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন। এ ছাড়া তাঁদেরও সাধারণ মানুষের তুলনায় হৃদ্রোগ ও অন্যান্য ঝুঁকি বেশি। তাই প্রিডায়াবেটিসকেও আমলে আনতে হবে। ওজন কমানো ও সপ্তাহে ১৫০ মিনিট ব্যায়াম (হাঁটাহাঁটি) করার মাধ্যমে রক্তের সুগার লেভেল প্রিডায়াবেটিস থেকে স্বাভাবিক মাত্রায় নামিয়ে আনা যায়।
৭. পরিবারে কারও ডায়াবেটিস না থাকলে ডায়াবেটিস হওয়ার ভয় নেই
এটা সত্য, পারিবারিক ইতিহাস থাকলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে দেখা যায়, অনেক ডায়াবেটিক রোগীর পরিবারে অন্য সদস্যদের ডায়াবেটিস নেই। পরিবারে কারও ডায়াবেটিস না থাকলেও যাঁদের স্থূলতা, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম ও প্রিডায়াবেটিস আছে এবং বয়স ৪০-এর ওপরে, তাঁদের ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি আছে।