বর্ষার শেষে শরৎ এসেছে। প্রকৃতির এই পরিবর্তনে সক্রিয় হয়ে গেছে কিছু রোগ সংক্রমণকারী ভাইরাস। বৃষ্টিতে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা জন্মের কারণে ডেঙ্গু যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বায়ুবাহিত রোগ ইনফ্লুয়েঞ্জা। সাধারণ মানুষের তুলনায় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ভাইরাল জ্বর বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। একদিকে গর্ভের সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা, অন্যদিকে এ সময় অনেক ওষুধের নিষেধাজ্ঞা। যেকোনো ধরনের জ্বরই গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকর। তাই এ সময়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
যেকোনো ধরনের জ্বরই গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকর। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ হলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। এ সময় ডেঙ্গুর জটিলতা; যেমন রক্তপাত, রক্ত ঘন হয়ে যাওয়া, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় (পেটে, ফুসফুসে) পানি জমা হওয়া এবং গর্ভপাত হওয়ার মতো বিষয়গুলো বেড়ে যায়। ভাইরাল জ্বরে গর্ভবতী নারীদের রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হতে পারে।
হেপাটাইটিস এ, বি ও ই এই সময় বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে হেপাটাইটিস ই–তে আক্রান্ত হলে মারাত্মক আকার ধারণ করে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সাধারণ বিষয় হলেও এর জটিলতায় মা মারা যেতে পারেন। হেপাটাইটিস বি–তে আক্রান্ত হলে গর্ভের শিশুও সংক্রমিত হয়।
রুবেলা অনেকটা হামের মতো। গর্ভবতী নারীদের রুবেলা হলে গর্ভপাত ও শিশুর জন্মগত ত্রুটির হার অনেক বেশি হয়।
করোনার প্রকোপ কমে এলেও গর্ভাবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হলে মা ও সন্তানের ক্ষেত্রে জটিলতা বেশি হয়।
গর্ভাবস্থায় জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ শিশুকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। শিশুর জন্মগত ত্রুটি সৃষ্টি করে। আমাদের দেশে জিকা ভাইরাস এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
ভেরিসিলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মায়ের ঝুঁকি অনেক বেশি হয়। এ ছাড়া শিশু সংক্রমিত হয়। দেখা দেয় শিশুর জন্মগত ত্রুটি।
অন্তঃসত্ত্বা নারীর ভাইরাল জ্বরে গর্ভের শিশুর কী ক্ষতি হতে পারে
গর্ভাবস্থায় জ্বর হলে মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।
গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসের মধ্যে জ্বর হলে গর্ভপাত বা মিসক্যারেজের আশঙ্কা থাকে। যেমন রুবেলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ৬৫ থেকে ৮৫ ভাগ আশঙ্কা থাকে।
কিছু কিছু ভাইরাল জ্বরে শিশুর জন্মগত ত্রুটি দেখা দেয়। যেমন হাম, রুবেলা, সাইটোমেগালো ভাইরাস, হারপিস সিমপেক্স ভাইরাস, ভেরিসিলা, পারভো ভাইরাস ইত্যাদি। এই ত্রুটিগুলোর মধ্যে হার্টে ছিদ্র থাকা, ব্রেন ও স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, বধির হয়ে যাওয়া, মানসিক প্রতিবন্ধকতা, অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার হয়ে থাকে।
চিকিৎসকের পরামর্শ কখন
তাপমাত্রা যদি ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হয়, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জ্বরের সঙ্গে যদি কাশি, গায়ে কোনো র্যাশ বা ফুসকুড়ি থাকে, মাথাব্যথা বা শরীরে ব্যথা থাকে, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অনেক সময় জ্বর এমনিতেই চলে যায়, তার পরও স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে।
ওষুধ কী
গর্ভাবস্থায় প্যারাসিটামল নিরাপদ ওষুধ; কিন্তু প্যারাসিটামলের সঙ্গে অনেক সময় ক্যাফেইন, কোডেইন বা অন্য কোনো উপাদান যোগ করা থাকে, তাই এগুলো বেশি খাওয়া যাবে না। কোনোভাবেই অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন–জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। গর্ভাবস্থায় অনেক ওষুধ শিশুর জন্মগত ত্রুটি তৈরি করে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করা উচিত হবে না।
প্রতিরোধে করণীয়
প্রতিরোধই সবচেয়ে ভালো নিরাময়। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ভাইরাল জ্বর প্রতিরোধ করতে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।
পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে হবে। এ সময় বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। প্রতিদিন গোসল করতে হবে ও পরিষ্কার কাপড় পরতে হবে।
অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। গর্ভাবস্থায় রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। এ সময় ভিড়, জনসমাগমপূর্ণ জায়গা ও অসুস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে।
গর্ভাবস্থায় ভাইরাল জ্বরের ঝুঁকি কমাতে গর্ভধারণের আগেই কিছু ভ্যাকসিন নেওয়া প্রয়োজন। যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, রুবেলা, হেপাটাইটিস, করোনার ইত্যাদি। আগে নেওয়া না থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে ভ্যাকসিন নিতে হবে।
প্রচুর পানীয় পান করুন। সেই সঙ্গে ভিটামিন সি খেতে হবে। ফলের রস, গরম চা, স্যুপ এই সময় আপনাকে আরাম দেবে, আবার ভাইরাসও বাড়তে দেবে না।
বাসায় তৈরি খাবার খান। বাইরের খাবার এড়িয়ে চলুন।
ভাইরাল জ্বর শরীরকে দুর্বল করে দেয়, তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।
ডা. আফলাতুন আকতার জাহান, মেডিসিন স্পেশালিস্ট, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড, ঢাকা।