ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিলোপ হওয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হলে আশপাশের মানুষকে চিনতে পারেন না রোগী। নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম করতেও ভুলে যান তাঁরা। ধীরে ধীরে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন আক্রান্ত ব্যক্তিরা। বর্তমানে ডিমেনশিয়া একটি ভয়ংকর ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
তবে প্রাত্যহিক জীবনে চলতে-ফিরতে অনেক কিছু মনে থাকছে না মানেই তা ডিমেনশিয়া নয়। যেমন ভুলে যাওয়ার সমস্যায় ভোগা বার্ধক্যের একটি সাধারণ সমস্যা। বয়স বাড়লে স্মৃতি অনেক সময় সঙ্গ দেয় না। অতি সাধারণ কথাও অনেক সময় মনে থাকে না। বাড়ির বয়স্ক সদস্যদের খেয়াল করলেই তা বোঝা যায়। তবে এই ভুলে যাওয়া রোগ যখন মারাত্মক হয়ে ওঠে, তখন অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। যেকোনো রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করা ভালো। কিন্তু ডিমেনশিয়া বা আলঝেইমারের মতো রোগের ক্ষেত্রে প্রতিরোধের বিষয়টি ততটাও সহজ নয়।
দৈনন্দিন জীবনযাপনে যদি ধারাবাহিক ভুলে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে, তখনই স্মৃতিভ্রম বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আলঝেইমারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি একধরনের ডিমেনশিয়া। এই রোগের নেপথ্যে কোন কারণগুলো আছে, নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কিছু উপসর্গ আছে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমনিতেও হতে পারে। যেমন
১. ডিমেনশিয়া থাকলে সংখ্যাজনিত সমস্যা দেখা দেয়। বড় অঙ্কের টাকার হিসাব করা তাদের পক্ষে একটু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তবে টাকা গুনতে গিয়ে অনেকেরই ভুল হয়ে যায়। একটা বয়সের পর এ রকম হতেই পারে। তাই বলে সেটাকে ডিমেনশিয়া ভেবে নেওয়ার কারণ নেই। কিন্তু এটা ক্রমাগত খারাপের দিকে যেতে থাকলে চিন্তিত হতে হবে।
২. ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা প্রায়ই কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন, কী বলছেন ভুলে যান। এই সমস্যা অন্য সাধারণ মানুষেরও হতে পারে। কখনো কোনো কথা বলতে গিয়ে যদি ঠিকঠাক শব্দবন্ধ মনে না পড়ে বা খেই হারিয়ে যায়, তার মানেই ডিমেনশিয়া নয়। তবে প্রায়ই হতে থাকলে সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
৩. দিন ভুলে যাচ্ছেন মানে আপনার ডিমেনশিয়া হয়েছে ভেবে নিয়েছেন? এটা অনেক দিন কোনো কর্মবিরতিতে থাকলেও হতে পারে। আমাদেরও প্রায়ই দিন-তারিখ মাথায় থাকে না, শেষে মুঠোফোন বা ক্যালেন্ডারের সাহায্য নিতে হয়। ডিমেনশিয়াতেও এই সমস্যা হয়, তবে এতটাই বড় আকারে যে তাঁরা বছরের কোনো দিনক্ষণই ঠিক করে মনে রাখতে পারেন না।
বয়স্ক ব্যক্তিদের, মানে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের ডিমেনশিয়ার অন্যতম কারণ হলো আলঝেইমার রোগ। এতে মস্তিষ্কের ক্ষয় হতে থাকে। আলঝেইমারের কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে। এগুলো হলো:
স্মৃতিভ্রংশ, যা দৈনন্দিন জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করছে।
সঠিক বিচার-বিবেচনার অভাব।
স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব এবং কোনো কাজে উৎসাহ বোধ না করা।
স্থান-কাল সম্পর্কে ভুল করা।
ভুলে যাওয়ার কারণে বারবার একই প্রশ্ন করা।
কোনো কাজ শেষ করতে আগের চেয়ে দীর্ঘ সময় লাগা।
টাকাপয়সার হিসাব, বিল ইত্যাদিতে জগাখিচুড়ি করে ফেলা।
নিজের জিনিসপত্র বারবার হারিয়ে ফেলা বা অদ্ভুত কোনো স্থানে রাখা (যেমন কাপড় রাখার আলমারির ভেতর জুতা রাখা)।
কখনো পথ বা বাড়ি হারিয়ে ফেলা বা উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরা।
অতিরিক্ত উদ্বেগ এবং কখনো অতিরিক্ত রাগ বা ক্রুদ্ধ ভাব, মুড ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হওয়া।
আপনার বাড়ির বয়স্ক সদস্যের দিকে খেয়াল করুন। অনেক সময় ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক লক্ষণগুলো এমন যে তাঁদের আচরণে অন্যরা বিব্রত বা বিরক্ত হন। কিন্তু এ ধরনের ভুলে যাওয়া এবং স্মৃতি-সংক্রান্ত কোনো সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিয়ে রাখা ভালো।
অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল, ঢাকা